র‌্যাডিকালিজম (Radicalism)

র‌্যাডিকালিজম (Radicalism)

(আরব বিশ্বের বিখ্যাত সাময়িকী ‘আল মুজতামা’ থেকে সংগৃহীত)

এ পরিভাষার মূল উৎপত্তি লাতিন ভাষা থেকে, যার অর্থ হল- জর বা শিকড়। সম্প্রতি গণমাধ্যম এবং রাজনীতিতে এ শব্দের ব্যবহার খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। মৌলিক উৎপত্তি অনুযায়ী এ পরিভাষা এমন চিন্তা-চেতনা, কর্মতৎপরতা অথবা আন্দোলনের জন্য নির্ধারিত ছিল যা বা যারা নির্দিষ্ট পরিধিতে মৌলিক সমস্যা বা ইস্যুসমূহ নিয়ে মাথা ঘামায়। বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমা সমাজ ও রাজনীতিতে এ পরিভাষাটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দির সমাপ্তিতে এবং বিংশ শতাব্দির প্রারম্ভে এ শব্দ দ্বারা ঐ সমস্ত রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনগুলোকে বুঝানো যেত যারা পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যেত। যেহেতু সে সময় এরূপ চিন্তাধারার ধারক বাহক ছিল বামপন্থি, সমাজতান্ত্রিক, সাম্যবাদী দলগুলো – তাই এ পরিভাষাটি তাদের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়।

কিন্তু এরূপ সংগঠনগুলোর আধিক্যতার দরূন এ পরিভাষাটিতে আরও প্রশস্ততা আসে। তাই কেবলমাত্র রাজনীতিতে সীমিত না থেকে এটা ঐ সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলোর জন্য ব্যবহার হতে লাগে যারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনতে চায়। সুতরাং বিংশ শতাব্দীর ক্রমান্বয়ে  র‌্যাডিকালিজম ঐ সমস্ত সংগঠনগুলোর জন্য ব্যবহৃত হতে লাগে, যারা পশ্চিমা সমাজ, সাহিত্য ও শিল্পব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামোকে পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নতুন দর্শন, সাহিত্য ও সমাজব্যবস্থা আনয়নের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল।

তারপর এ প্রশস্ততার মধ্যে খানিক সংকীর্ণতা এসে এ পরিভাষাটি ঐ সমস্ত সংগঠন সমূহের উপর আরোপ হতে লাগে, যারা অত্যন্ত কঠোর পরিবর্তন, প্রাচীন প্রথাসমূহকে বয়কট ও মুলোৎপাটন, তথাপি মানব জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আমূল বিপ্লব ঘটাতে চায়। এর বিপরীত আসে ঐ সমস্ত সংগঠন সমূহ, যারা সীমিত ও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনতে চায়। এক কথায়, গত কয়েক দশকে এ পরিভাষাটি ‘বিপ্লবী’ শব্দের সমার্থক হয়ে যায়। এ পরিভাষাটির পরিণতিও ‘বিপ্লবী’র পরিণতির গতিপথ ধরে, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের পতন ও পূঁজিবাদের পূণর্বস্থানের সাথে সাথে এটাও একটি কুখ্যাত শব্দে পরিণত হয়। গত দু‘দশকে এ পরিভাষাটিতে আরও রদবদল হয়, এবং বিশ্বের অনেক দেশে এটা গুটি কয়েক ইসলামী সংগঠনসমূহের জন্য ব্যবহার হতে লাগে। এমতাবস্থায় ‘র‌্যাডিকালিজম’ ঐ সমস্ত পরিভাষাসমূহের সমার্থ হয়ে দাড়ায়, যেগুলো থেকে অশৃঙ্খলা ও অরাজকতার গন্ধ বের হয়, যেমন চরমপন্থা, মৌলবাদ  এবং সন্ত্রাসবাদ।

পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ ও অনেক মুসলমান রাষ্ট্রসমূহে যখন একাডেমিক আর্টিকলগুলোতে এ পরিভাষাটি ইসলামী সংগঠনগুলোর জন্য ব্যবহার হয়, তখন এর মতলব হয় ঐ সমস্ত দলসমূহ যারা ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। এ কথাটি স্পষ্ট যে- এর মাধ্যমে পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থি লেখকরা ঐ সমস্ত সংগঠনগুলোকে আলাদা করতে চান, যারা পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করতে চায় না। এসব বুদ্ধিজীবিদের মতে এরকম সংগঠনসমূহ ‘মধ্যপন্থি’। আধুনিক পশ্চিমা সমাজে ‘বিপ্লবী’ একটি নিন্দনীয় ও গর্হিত শব্দ। এমনকি ‘বিপ্লবী’ রাষ্ট্রগুলোতেও এটা পরিত্যক্ত।

‘র‌্যাডিকালিজম’ এভাবেই এ শতাব্দীতে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে থাকে; যদিও এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে ইউরোপের অবস্থান- তাদের সমাজ ও দর্শনের বৈপ্লবিক ইস্যুসমূহের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। বৈপ্লবিক চিন্তার মধ্যে চরম উৎকষ ও সুদীর্ঘ সমৃদ্ধির পর ভাঁটা পড়ে যায়। তেমনিভাবে ‘র‌্যাডিকালিজমে’র  এককালীন অর্থ ছিল সাহসী   চিন্তাধারা, সৃজনশীলতা, সমাধান পেশ করা ও সংস্কার করা; কিন্তু বর্তমানে এর অর্থ হয়ে গেছে – অনঢ়তা, বদ্ধতা, অবাস্তবিক পদক্ষেপ নেয়া ও সূ² অনুধাবন থেকে অপারগতা, ইত্যাদি। সম্ভবত, বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় উজ্জীবিত ইসলামী সংগঠনসমূহের উপর এ পরিভাষা প্রয়োগ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে – তাদের বাস্তব রূপকে বিকৃত করে সমাজে তাদেরকে অপ্রগতিশীল, অবাস্তব এবং সেকেলে চিন্তাধারার ধারক-বাহক হিসেবে উপস্থাপন করা।

সত্য হচ্ছে যে  – পশ্চিমা বিশ্বে র‌্যাডিকাল, বৈপ্লবিক চিন্তাধারার পতনের পর থেকে এ পরিভাষাটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাইতো এটা কেবলমাত্র অপশ্চিমা ও মুসলমান রাষ্ট্রসমূহ, অথবা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের গুটি কয়েক সংগঠনের জন্য ব্যবহার হয়। আর সম্ভবত পশ্চিমা রাজনীতি এবং সমাজব্যবস্থায় বৈপ্লবিক চিন্তার ধারক সংগঠনসমূহের অনুপস্থিতিই এ পরিভাষার বিলুপিÍর নেপথ্যে। এজন্যই অন্যান্য পশ্চিমা পরিভাষাগুলোর মত এটাও নিজস্ব অর্থের বদলে অন্যান্য অর্থসমূহে ব্যবহৃত হতে থাকে।

Scroll to Top