জুমুআর খুতবার ভাষা

জুমুআর খুতবার ভাষা

আরবী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় জুমুআর খুতবা প্রদান করা নাজায়েয এবং বিদআত।

ভূমিকা

জুমুআর নামাজের শর্তগুলোর একটি হল যে, ইমাম সাহেব নামাজের পূর্বে খুতবা প্রদান করবেন। খুতবার শুরু থেকেই উপস্থিত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব (আবশ্যকীয়)। যেহেতু খুতবা জুমুআর নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট ও নিয়ম-কানুন রয়েছে যার মাধ্যমে এটা অন্যান্য সাধারণ ওয়াজ ও বক্তব্য থেকে ভিন্ন গণ্য করা হয়।

তন্মধ্যে একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে যে, নামাজের মত এটাও আরবী ভাষায় প্রদান করতে হবে। ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে, তাবেয়ীন ও তবে তাবিয়ীনসহ নিকট অতীত পর্যন্ত সমস্ত মুসলমানরা আরবী ভাষায় খুতবা প্রদান করেছেন। এমনকি যেখানে শ্রোতারা অনারব ছিলেন এবং আরবী ভাষা বুঝতে অপারগ ছিলেন।

জুমুআর খুতবা কি এক ধরণের ইবাদত না ওয়াজ যার উদ্দেশ্য হল মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে অবহিত করা?

কুরআনে করীমের নিম্নোক্ত আয়াতে খুতবাকে যিকর নামে উল্লেখ করা হয়েছে:

  يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ

হে মুমিনগণ! যখন জুমুআর দিন নামাযের দিকে আহবান করা হয়, তখন যিকরের দিকে তড়িৎ গতিতে যাও এবং ব্যবসা বাণিজ্য ত্যাগ কর। (সূরা জুমুআ: ৯)

তেমনিভাবে, অনেক সহীহ হাদীসে খুতবাকে যিকর নামে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত এক হাদীসে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলমানদেরকে যত শীঘ্রই সম্ভব জুমুআর দিন মসজিদে উপস্থিত হওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে ইরশাদ করেন:

فإذا خرج الإمام حضرت الملائكة يستمعون الذكر

যখন ইমাম সাহেব (খুতবা প্রদান করতে) বের হন ফেরেশতারা তখন যিকর শুনার জন্য উপস্থিত হন। (সহীহ বুখারী)

উপরের আলোচনা থেকে এ কথাটি দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কুরআনে করীম এবং সহীহ হাদীসগুলোতে খুতবার জন্য যিকর শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যিকরের অর্থ হল, আল্লাহ তাআলার নাম জপ করা। অন্যদিকে তাযকীরের অর্থ হল, নসীহত করা। সুতরাং, এর মাধ্যমের বুঝা গেল যে খুতবার আসল উদ্দেশ্য হল যিকর, তাযকীর নয়। এবং এটা এক ধরণের ইবাদত, সাধারণ ওয়াজের মত নয়।

ইবাদতের ভাষা কী?

ইসলাম ধর্মে বিভিন্ন ধরণের ফরজ ও সুন্নাত ইবাদত রয়েছে যা শুধু আরবীতেই আদায় করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ:

ক্স নামাজ: প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ আরবীতে আদায় করা জরুরী। এই নিয়ম অনারবদের জন্যও প্রযোজ্য, যদিও সাধারণত তারা নামাজে যা পড়েন তার অর্থ বুঝতে সক্ষম নন।

ক্স আযান: নামাজের আযান প্রত্যেক অঞ্চলে সেখানের মুসলমানদেরকে নামাযের দিকে আহবান করতে প্রদান করা হয়। আযান আরবীতে দেয়া জরুরী। অন্য কোন ভাষায় দিলে তা আদায় হবে না।

ক্স হজ্ব: হজ্বের তালবিয়া (لبيك اللّٰهم لبيك) আরবীতে পাঠ করা জরুরী। এ শব্দগুলোর অনুবাদ জপ করা প্রহণযোগ্য নয়।

সাহাবায়ে কেরামের আমল

যদি কোন ইমাম সাহেব শুধু হামদ (আল্লাহ তাআলার প্রশংসা), নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর সালাত ও সালাম (দরূদ) পাঠ, কুরআন করীম থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত এবং দোয়ার মাধ্যমে তার খুতবা প্রদান করেন, এবং এতে কোন ধরণের ওয়াজ-নসীহত না-ও করেন, তারপরও তার সে খুতবা গ্রহণযোগ্য হবে। এবং এ খুতবার পর জুমুআর নামাজ আদায় করা বৈধ হবে।

যদি খুতবার উদ্দেশ্য হত ওয়াজ-নসীহত করা, তাহলে খুতবার মৌলিক উপাদানগুলো হত ওয়াজ-নসীহত সম্পর্কিত কিছু কথা। এগুলো ব্যতীত খুতবা বৈধ হত না। কিন্তু, বাস্তবে এগুলো ছাড়াও খুতবা বৈধ হয়ে যায়।

হযরত উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহ্) খলীফার হওয়ার পর সর্বপ্রথম খুতবা এভাবেই প্রদান করেছিলেন, এবং ওয়াজ-নসীহত সম্পর্কিত কোন কথা উল্লেখ করেননি। তা সত্তেও তাঁর খুতবা বৈধ ছিল। সাহাবায়ে কেরামের বিশাল সংখ্যার মধ্য থেকে কেউও তার খুতবা গ্রহণযোগ্য নয় বলে ফতোয়া দেননি।

এ ঘটনাটিও ঐ বক্তব্যের একটি শক্ত দলীল যে, খুতবার মূল উদ্দেশ্য হল যিকর, তাযকীর নয়। এবং জুমুআর নামাযের অংশ হিসেবে এটি এক ধরণের ইবাদত, ওয়াজ-নসীহতের ন্যায় নয়।

ফকীহ ইমামগণের অভিমত

মালিকী মাযহাব: 

মালিকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব মিনাহুল জালীল গ্রন্থে উল্লেখ আছে:

নামাজের পূর্বে উভয় খুতবা প্রদান করা জরুরী। এটা একটি শর্ত যে এগুলো আরবীতে হতে হবে… যদিও  শ্রোতারা অনারব বা বধির হন। যদি এমন কোন ব্যক্তি পাওয়া যায় না যিনি আরবীতে খুতবা প্রদান করতে পারেন, তাহলে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের উপর জুমুআ আদায় করা ফরজ নয়।

শাফিয়ী মাযহাব:

শাফিয়ী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ইমাম আর-রামলী লিখেন:

খুতবা বৈধ হওয়ার জন্য একটি শর্ত হল যে এটা আরবীতে দিতে হবে। এর মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের অনুসারীদের অনুসরণ করা হয়। এবং এ কারণে আরবী ভাষা শেখা ফরজে কিফায়া। সুতরাং একজন ব্যক্তি আরবী শিখলেই হবে। … কিন্তু কেউই যদি তা শিখে না তাহলে সবাই গুনাহগার হবে এবং তাদের জুমুআর নামাজ বৈধ হবে না। বরং তারা জোহরের নামায আদায় করতে হবে।

হাম্বালী মাযহাব

হাম্বালী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আল-বুহুতী লিখেন:

এবং আরবীতে খুতবা প্রদান করার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো ভাষায় খুতবা প্রদান করলে তা আদায় হবে না। এটা কুরআন তেলাওয়াত করার মত যা আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আদায় করা যায় না। তবে অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দেয়া জায়েয আছে, যদি এমন কোন ব্যক্তি না থাকেন যিনি আরবীতে খুতবা দিতে সক্ষম। তা সত্তেও (খুতবার মধ্যে) আরবী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় তেলাওয়াত করা জায়েয হবে না। যদি কেউ আরবীতে তেলাওয়াত করতে অক্ষম হন, তাহলে তার জন্য উচিত হল কুরআন তেলাওয়াতের পরিবর্তে কোন জিকর পড়ে নেয়া, যেভাবে নামাজে করতে হয় (যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করতে অক্ষম, তার জন্য যে কোনো জিকর পড়ে নেয়া যথেষ্ট)।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল যে, এই ব্যতিক্রমধর্মী নিয়ম শুধুমাত্র ঐ অবস্থায় প্রযোজ্য যখন জুমুআর ইমাম আরবীতে খুতবা দিতে অপারগ। শুধুমাত্র মুসল্লীরা আরবী বুঝতে অপারগ হলে তা প্রযোজ্য নয়।

হানাফী মাযহাব

হানাফী মাযহাব অনুযায়ীও বাকী তিন মাযহাবগুলোর মত আরবী ভাষায় জুমুআর খুতবা প্রদান করা জরুরী। অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দেয়া জায়েয নয়।

ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) এর বিশিষ্ট দুই শাগরেদ ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মত হল যে, আরবী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দিলে জুমুআর নামাজের শর্ত আদায় হবে না। তাই এমন খুতবার পর জুমুআর নামাজ আদায় করা বৈধ হবে না। আরবীতে পূনরায় খুতবা প্রদান করতে হবে। নতুবা জুমুআর নামায আদায় হবে না। তবে যদি পুরো সমাজে কোন ব্যক্তিই আরবীতে খুতবা দেয়ার সামর্থ রাখে না তাহলে এমতাবস্থায় জরুরতবশত আরবী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দেয়ার অনুমতি আছে।

পক্ষান্তরে, ইমাম আবূ হানীফার মত হল যে, আরবী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দেয়া যদিও মাকরূহ; কিন্তু এর মাধ্যমে জুমুআর নামাজ বাতিল হয়ে যাবে না। অর্থাৎ এর মাধ্যমে শুধুমাত্র জুমুআর নামাজ না আদায় করার গুনাহ থেকে বাঁচা যাবে।

উপসংহার

১. খুতবা হল জুমুআর নামাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং এটা এক ধরণের ইবাদত। ইবাদতসমূহ যুক্তির আলোকে পালন করা হয় না। বরং এগুলোর নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন আছে, যেগুলো অনুযায়ী তা আদায় করতে হবে। যুক্তির মাধ্যমে তা কখনও পরিবর্তন করা যাবে না। ইবাদতের মৌলিক উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ আনুগত্য। যদিও এগুলোর গূঢ় তাৎপর্য আমাদের বুঝে না আসে।  

২. শত শত বছর ধরে উম্মতের নিয়মিত আমল আরবী ভাষায় জুমুআর খুতবা প্রদান করার উপর ছিল। এমনকি অনারব দেশগুলোতেও।

৩.       ইসলামী ফিকহ ও আইনের সকল মাযহাবগুলোর সর্বসম্মত রায় হল যে, খুতবা আরবী ভাষায় দেয়া আবশ্যকীয়।

৪.       এমন সর্বসম্মত অভিমতকে পরিহার করা সমাজে কল্যাণ বয়ে আনা তো দূরের কথা, উম্মতের মধ্যে মতানৈক্য ও ফিতনা বৈ কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না।

৫.       আরবীতে খুতবা প্রদান করা সবার মতেই গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে, অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দেয়া  অধিকাংশ মুসলমানদের মতে নাজায়েয। 

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে আরও জানতে পড়ুন:

মুফতি তাক্বী উসমানী রচিত পুস্তিকা: The Language of the Friday Khutbah by Mufti Muhammad Taqi Usmani, Idaratul Ma’arif, Karachi, Pakistan.

পুস্তিকাটি অনলাইনে ফ্রী পাওয়া যায়। 

লিখেছেন: মাওলানা হাফিজ হাবীবুল্লাহ

বঙ্গানুবাদ: মাওলানা হাফিজ আব্দুল্লাহ ফাহীম

Scroll to Top