আব্দুল্লাহ ফাহীম, বার্মিংহাম
তারিখ: ০২/০৩/২০১৩
ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যায় যে নাস্তিকতা পৃথিবীর প্রতিটি সমাজ ও দেশে এবং সব সময়ই একটি অজনপ্রিয় মতবাদ হিসেবে গণ্য ছিল; যদিও ইদানীং সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এক ধরণের ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলো – যেমন গ্রীক ও রোমানরা বিভিন্ন দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল । সেখানকার লোকেরা দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরী করে সেগুলোর উপাসনা করত। এক কথায় – তারাও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিল।
সে সময় কিছু কিছু দার্শনিকরা সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি ও ধর্মকে নিয়ে সন্দীহান হয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং তাদের লেখনীতে মূর্তিপূজা থেকে শুরু করে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। আমাদের জানামতে – সর্বপ্রথম ব্যাক্তি যিনি এরকম চিন্তা লালন-পালন করেছিলেন, তার নাম হল ‘অ্যানাক্সাগোরাস’ (Anaxagoras)। অ্যানাক্সাগোরাস বিশ্বাস করতেন যে – সূর্য হল এক ধরণের অগ্নি-পাথর। যা তখনকার যুগের জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিপরীত ছিল। এ জন্য তাকে নির্বাসনে যেতে হয়। তার মৃত্যু হয়েছে খৃষ্টপূর্ব (৫০০-৪২৭) সালের মধ্যবর্তী সময়।
(দেখুন: http://beinghuman.blogs.fi/2009/01/25/who-was-the-first-atheist-5444582/)
এ তথ্য অনুযায়ী – পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্বঘোষিত এবং অনুশীলনকারী নাস্তিকের নাম হল ‘অ্যানাক্সাগোরাস’।
আধুনিক যুগের পূর্বে নাস্তিকতা কখনও এত সংগঠিতভাবে আবির্ভূত হয়নি। মধ্যযূগে (ইউরোপের অন্ধকার যুগ হিসেবে আখ্যায়িত) যারা ইউরোপীয় সমাজে প্রচলিত খৃষ্টধর্মের বিলীফ ও বিশ্বাস বিরোধী কোন আইডিয়া নিয়ে উপস্থাপিত হতেন, তাদেরকে ‘হেরেটিক’ (Heretic) তথা ধর্মদ্রোহী আখ্যায়িত করা হত। তাদের জন্য অপেক্ষা করত হরেক-রকমের মর্মান্তিক শাস্তি। অনেক বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং আবিষ্কারককে গীর্জার আইনানুযায়ী শুলিবদ্ধ করা হয়, ফাঁসি দেয়া হয়, জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়া হয়। আবার অনেককেই কাটতে হয় যাবজ্জীবন নির্বাসন। গ্যালিলিওর (Galileo Galilei) মত স্বনামধন্যমহাকাশবিজ্ঞানীকে, একজন ধর্মপ্রাণ খৃষ্টান হওয়া সত্ত্বেও – ইতালীয়ান সমাজ থেকে বয়কট করে তার সাথে সবধরণের লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘পৃথিবী ঘূর্ণ্যমান’। অন্যদিকে বাইবেল বলে, (The world is firmly established. It cannot be moved) অর্থাৎ – ‘পৃথিবী আপন স্থানে স্থীর। ইহা ঘুরিতে পারেনা’।
(দেখুন: http://www.enchantedlearning.com/inventors/page/g/galileo.shtml)
মধ্যযুগে ইউরোপের একটি কুখ্যাত ও ভয়ানক শব্দ ছিল ‘ইনকুইজিশন’ (Inquisition)। এটা রোমান ক্যাথলিক চার্চের এমন একটি কমিশনের নাম, যার দায়িত্ব ছিল ঐ সমস্ত লোকদেরকে সনাক্ত করা যারা ক্যাথলিক ধর্ম-বিশ্বাস ব্যতীত অন্য কোন মতবাদে বিশ্বাসী। তন্মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতি পায় ‘স্পানিশ ইনকুইজিশন’ (Spanish Inquisition) যা ‘টমাস ডা টোরকোমাডা’র (১৪২০ – ১৪৯৮) (Tomas de Torquemada) পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। স্পেনের মাটিতে যখন মুসলমানরা তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিল, ঠিক তখনই ইনকুইজিশনের বহির্প্রকাশ ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও এ অভূতপূর্ব তদন্ত-পদ্ধতিটি শুধুমাত্র মুসলমান ও ইহুদীদের জন্য প্রয়োগ করা হয়; কিন্তু সময়ের আবর্তনে খৃষ্টানদেরকেও তাদের নিজেদের তৈরী ফাঁদে পা দিতে হয় এবং তাদের উপরও দুর্দিন আসতে লাগে।
ইনকুইজিটাররা (Inquisitor) মানুষের ঘরে ঘরে হানা দিয়ে যাদের উপর তারা সামান্য মাত্র সন্দেহ করত – তাদেরকে ‘ধর্মদ্রোহীতা’র (Heresy) অভিযোগ দিয়ে গ্রেফতার করত। অতপর শুরু হত তদন্ত পর্ব। তথ্য উদগাঠন এবং অপরাধ স্বীকারোক্তির নামে করা হত নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক পৈশাচিক নির্যাতন । তারপর বিচারের নামে প্রহসন করে গীর্জার একপক্ষীয় শুনানির পরই শাস্তি ঘোষণা করা হত। উইচক্রাফ্ট (Witchcraft) তথা জাদুবিদ্যা চর্চার শাস্তি ছিল – জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়া। এ সময় খৃষ্টবাদের মধ্যে বিভক্তি শুরু হলে, অন্যান্য খৃষ্টধর্মীয় মতবাদগুলোর অনুসারীদেরকেও পড়তে হয় ইনকুইজিশনের কবলে। প্রটেস্টানদেরকে শুলীবদ্ধ করে জীবন্ত জালিয়ে দেয়া হয়।
(দেখুন: http://history.howstuffworks.com/historical-figures/spanish-inquisition.htm)
খৃষ্টান পাদ্রীরা ধর্মের নামে কৃষক ও নিম্নবিত্তদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের মাশুল ও কর আদায় করত । এতে করে অনেক গীর্জাই সম্পদের খাজানায় পরিণত হয়। গীর্জার নানা ধরণের জুলুম ও অত্যাচারের প্রভাব পড়তে শুরু করে জনমনে। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্ররা গীর্জায় হানা দিয়ে লুটতরাজ চালায়। ১৭৮৯ সালে তৎকালীন ফ্রান্সের রাজা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর (বিত্তবান) জুলুম ও অত্যাচারে জর্জরিত জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে গণবিপ্লব ঘটায়। পরবর্তীতে এ বিপ্লব গণতান্ত্রিক বিপ্লব রূপে উদীয়মান হয়। ধীরে ধীরে পাদ্রীদের শান ও শওকত হৃাস পায়। ইউরোপের গীর্জাগুলো ভক্তশুন্য হয়ে পড়ে।
(দেখুন: http://www.britannica.com/EBchecked/topic/219315/French-Revolution)
খৃষ্টবাদের লেবাসে নরপশু, সম্পদলোভী পাদ্রীদের জুলুম – অত্যাচারের দৃশ্যগুলো তখনকার লিখিত অনেক উপন্যাস, নাটক এবং কবিতাসমূহে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইনকুইজশনের উপর অনেক ফিল্ম ও তৈরী করা হয় ।
অবশেষে সাধারণ খৃষ্টানদের আক্রোষ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। জন্ম হয় নতুন কিছু মতবাদের । মার্টিন লুথার আবিষ্কার করেন প্রটেস্টান্ট মতবাদ। দার্শনিকরা নিয়ে আসেন বিভিন্ন বস্তুবাদী এবং নাস্তিক্যবাদী থিওরী। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন তার মহাবিতর্কিত ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেসিজ বাই মীন্স অব ন্যাচারাল সিলেকশন’ (On the Origin of Species by Means of Natural Selection) গ্রন্থটি রচনা করেন; যা পশ্চিমা সমাজে এক নব উত্তাল সৃষ্টি করে। ডারউইন তার গ্রন্থে বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তার বীজ বপন করেন। যদিও তার ‘থিওরী অব ইভোলুশন’ (Theory of Evolution) পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর মাধ্যমে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রমানিত হয়, তথাপি পশ্চিমারা এটার বহুল প্রচার প্রসার করে। কারণ এ থিওরী খৃষ্টবাদের উপর মুগুরের মত আঘাত করে।
(দেখুন: http://www.bbc.co.uk/history/historic_figures/darwin_charles.shtml)
পর্যায়ক্রমে পশ্চিমা জগতে খৃষ্টধর্মের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা লোপ পায়। ‘ধর্মপ্রাণ’ একটি গালিতে পরিণত হয়। শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে ইউরোপে বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনা খুবই দ্রæত বিস্তার লাভ করতে থাকে। রাষ্ট্রকে গীর্জা ও ধর্মযাজকদের আগ্রাসী কবল থেকে আলাদা করার দাবী-দাবা উঠতে থাকে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে রাজা-বাদশারা পাদ্রীদের খোদাপ্রদত্ত (?) ক্ষমতাকে কেড়ে নেয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ধর্মকে চীর বিতাড়িত করে এর বদলে নিয়ে আসা হয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ এবং এধরণের আরো অনেক মানবতৈরী মতবাদসমূহকে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে – পশ্চিমা বিশ্বে নাস্তিকতার এই চরম উৎকর্ষের পিছনে সবচেয়ে বেশী অবদান রেখেছে ধর্মব্যবসায়ী খৃষ্টান পাদ্রীরা। খৃষ্টবাদে বিদ্যমান অনেক অযৌক্তিক এবং বিকৃত তথ্যও এতে ইন্দন যোগায়। বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কার বিকৃত বাইবেলকে মিথ্যা বলে প্রমাণিত করে।
ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা বিশ্বে খৃষ্টবাদের অনুসারীদের সংখ্যা কমে আসে। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী – সমস্ত বৃটেনে কেবলমাত্র শতকরা ৫৯ ভাগ মানুষ খৃষ্টান, অথচ ২০০১ সালে খৃষ্টানরা ছিল ৭২%।
(দেখুন: বিবিসি http://www.bbc.co.uk/news/uk-20683744)
ইদানীং যেহেতু বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই পশ্চিমা শিক্ষা-ব্যবস্থা বিরাজমান এবং সর্বত্রই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার ঘটানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে, মুসলমান ও অমুসলমান উভয়ই এ ক্ষেত্রে বরাবর ভূমিকা রাখছে – তাই নাস্তিকতার ভয়াল আগ্রাসন এবং বিষাক্ত ছোঁয়া থেকে কোন রাষ্ট্রই নিরাপদ নয়। আর এগুলো ভেসে উঠে দর্শন, সাহিত্য, সংবাদ-মাধ্যম এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পাশ্চাত্যে যেহেতু খৃষ্টবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই সেখানে টার্গেট করা হয় খৃষ্টানদেরকে। আর মুসলিম বিশ্বে আক্রান্ত করা হয় মুসলমানদেরকে।
উল্লেখ্য যে – মধ্যযুগে যখন ইউরোপীয়ানরা তাদের ইতিহাসের অন্ধকারতম সময় অতিক্রম করছিল, তখন মুসলমানরা আরব ও মধ্য এশিয়ায় উসমানী খেলাফতের অধীনে, এবং ভারতে মোঘল স¤্রাজ্যের অধীনে তাদের সোনালী যুগ অতিক্রম করছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে – মুসলমান আলেম-ওলামারা কখনও সম্মিলিতভাবে ইসলামের অপব্যবহার করেননি। ধর্ম রক্ষার নাম নিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসা সমূহকে জুলুম ও নির্যাতনের দূর্গ হিসেবে কস্মিনকালেও ব্যবহার করা হয়নি। বরং সময়ে সময়ে যখন সাধারণ মুসলমানরা গাফেল হয়ে যেত, তখন আলেমরাই তাদেরকে অত্যাচার এবং অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলতেন। তাই মুসলিম বিশ্বে বসবাসরত নাস্তিকদের এই দাবী ‘‘মসজিদ ও রাষ্ট্র পৃথক রাখা উচিত’’ মোটেই যুক্তিসংগত নয়।
ইসলাম কখনও নাস্তিকতার উৎকর্ষে ইন্দন যোগায়নি। মুসলিম দেশগুলোতে বসবাসরত নাস্তিকরা হয়ত ইসলাম সম্বন্ধে বিলকুল অজ্ঞ, অথবা তারা ঘৃণাবাদী, নামলোভী, পরজীবীর দল। তারা কদাচিৎই ইসলামকে অধ্যয়ন করে; আর যদি কখনও করে তাহলে তা ঘৃণাবাদী প্রাচ্যবিদ (Orientalists) খৃষ্টান পণ্ডিতদের বই-পুস্তক থেকে। তারা নিজেদেরকে মুক্তমনা দাবী করে। অথচ তাদের মত গোঁড়া, সংকীর্ণমনা লোক পাওয়াই দুরূহ।
ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত কেবলমত্র কিছু প্রথা, রীতি-নীতি ও উৎসবের নাম নয়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের আদেশ-নির্দেশগুলো প্রথা নয়, বরং এগুলো হল বিধান ও আইন-কানুন। ইসলামের রয়েছে নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা, নিজস্ব অর্থব্যবস্থা এবং অনন্য সমাজব্যবস্থা।
মজার বিষয় হলো যে – একদিকে যখন পশ্চিমা সমাজে খৃষ্টবাদের চরম পতন ঘটছে, ঠিক তখনই ঘটছে ইসলামের অভূতপূর্ব উত্তান। শুধু গত বছরই (২০১২ সালে) বৃটেনে প্রায় ৫,০০০ ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ হলেন মহিলারা।
(দেখুন: বিবিসি http://www.bbc.co.uk/blogs/tv/posts/Make-Me-A-Muslim-What-brings-women-to-faith)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের মাত্র একটি আয়াত মহাবিজ্ঞানী মরিস বুকাইলিকে ইসলামের সত্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য করে। তিনি ইসলাম কবুল করে তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘The Bible, The Qur’an and Science’ রচনা করেন, যেখানে তিনি প্রমান করেন যে – কোরআন শরীফের শত শত আয়াত সমূহ আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারেরই উৎস।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঈমান ও ইসলামের বাস্তবিক আলো দ্বারা আলোকিত করুন। আমীন।