তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত না ৮ রাকাত সুন্নাত?

তারাবীহ নামাজ ২০ রাকাত না ৮ রাকাত সুন্নাত?

ইদানীং আমাদের মুসলিম সমাজে তারাবীহ নামাজের রাকাতের সংখ্যা নিয়ে চরম মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এ অনাকাংখিত সমস্য সৃষ্ঠির জন্যে এক শ্রেণীর লা-মাজহাবীরাই দায়ী। তাদের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থেকে আমাদের ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের’ অনুসারীদের রক্ষা এবং তাদের প্রতি এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্যনির্ভর আলোচনা পেশ করতে আজকের আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

রাসূল (স.), সাহাবায়ে কেরাম (রা.), তাবে‘য়ীন, তাবে তাবে‘য়ীন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তারাবীহ নামাজ বিশ রাকাত। কিন্তু ১২শ ৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরাবাদ থেকে সর্বপ্রথম এক লা-মাজহাবী মৌলভী সাহেব ৮ রাকাত তারাবীহ‘র ফাতওয়া প্রদান করেন। এরপর ১২শ ৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে মাওলানা মোহাম্মদ হুসাইন বাটালবী ৮ রাকাত তারাবীহ নামাজ সুন্নাত হওয়ার দাবী করেন। কিন্তু কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে বিজ্ঞ তৎকালীন হক্কানী উলামায়ে কেরামগণ উক্ত ৮ রাকাত তারাবীহ‘র ফাতওয়াকে ভুল হিসেবে প্রমাণিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৩শ ৭৭ হিজরীতে শায়েখ নসীব রেফা‘য়ী ও শায়েখ নাসির উদ্দিন আলবানি সর্বপ্রথম ৮ রাকাত তারাবীহ‘র ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন। তখন শায়েখ আতিয়্যা সালিম সহ আরবের সমস্ত উলামায়ে কেরাম তাদের উক্ত রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন। এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর যুগ থেকে চলে আসা হারামাইন-শরীফাইন তথা বাইতুল্লাহ শরীফ ও মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ‘র আমলকে অব্যাহত রাখেন। যা আজো অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং- ৮ রাকাত তারাবীহ পড়ার মতকে অনুসরণের অর্থ হলো সাহাবা ও তাবেয়ীনগণের অনুসৃত আমলকে প্রত্যাখ্যান করে নব্যসৃষ্ট বিদ‘আতী দলের অনুসরণ করা।

তারাবীহ নামাজ বিশ রাকাতের প্রমাণ

১)  হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) রমজান মাসে বিশ রাকাত নামাজ পড়তেন এবং বিতির পড়তেন। (মুসান্নাফে আবী শাইবা- ২/২৯৪, হাদীস নং ৭৬৯২, মুসনদে আবদ্ বিন হুমাইদ- ২১৮, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীস নং ১২১০২, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং ১৭২, সুনানে বায়হাক্বী কুবরা, হাদীস নং ৪৩৯১)

২)  হযরত জাবের (রা.) বলেন, রমজান মাসের একরাতে রাসূল (স.) বাহিরে তাশরীফ নিয়ে এলেন। আর সাহাবায়ে কেরামকে ২৪ রাকাত [৪ রাকাত ইশার, ২০ রাকাত তারাবীহ‘র] নামাজ পড়ালেন। আর তিন রাকাত বিতির পড়ালেন (তারীখে জুরজান)।

৩)  হযরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত উমর (রা.) লোকদেরকে হযরত উবাই বিন কা‘আব (রা.) এর কাছে একত্র করে দিলেন। আর তিনি লোকদের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন। (সুনানে আবু দাউদ- ১/১০২)

৪)  হযরত আবুল হাসানাহ বলেন, হযরত আলী (রা.) এক ব্যক্তিকে পাঁচ তারাবীহ এক সাথে বিশ রাকাত পড়াতে হুকুম দিয়েছেন। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাক্বী, হাদীস নং- ৪৮০৫, কানজুল উম্মাল, হাদীস নং- ২৩,৪৭৪)

রাসূল (স.) এর চার খলীফার সুন্নাত আদর্শ ও আমল

বিশেষ করে সাহাবাদের মধ্যে রাসূল (স.) এর চার খলীফার সুন্নাত আদর্শ ও আমল এবং আকীদাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার প্রতি রাসূল (স.) জোর তাকিদ দিয়ে বলেছেন – ‘আমার পরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে অচিরেই বিভিন্ন মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং আদর্শের অনুসরণ করবে। তা কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরবে। (আবু দাউদ: ৪/২০০(৪৬০৭) তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

উপরোক্ত হাদীসে সকল সাহাবা (রা.) গণকে সত্যের মানদন্ড এবং শরীয়তের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণকে অপরিহার্য এবং তাঁদের সুন্নাত – বিশেষত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে, নবীজী (স.) নিজের সুন্নাতের সমপর্যায়ের ঘোষণা দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, খোলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূল (স.) এটা জেনেছিলেন যে, তাদের জারীকৃত যে কোন আমল বা সুন্নাত নবীজী (স.) এর বাণী সুন্নাতেরই অনুগামী হবে। এ কারণে নবীজী (স.) খোলাফাদের সুন্নাতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধারার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কাজেই উম্মতের সামনে যে কোন একজন খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলে তা অনুসরণের ক্ষেত্রে ভিন্ন কোন দলীলের প্রয়োজন হবে না; বরং নবীজীর (স.) উপরোক্ত নির্দেশনামূলক হাদীসই যথেষ্ট হবে। এ ব্যাপারে খলীফায়ে রাশেদের সুন্নাতটি নবী (স.) এর শিক্ষা বা সুন্নাতের কোন্ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত- তাও দেখার প্রয়োজন নেই। অন্য এক হাদীসে রাসূল (স.) বলেছেন- “খেলাফতের মেয়াদ আমার ইন্তেকালের পর ত্রিশ বৎসর চলবে” (তিরমিযী ২২২৬)। এ ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে খোলাফায়ে রাশেদীন চারজন তথা আবূবকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.) এবং আলী (রা.)। উল্লেখ্য, হযরত আলীর (রা.) শাহাদাত হয়েছে রাসূল (স.) এর ওফাতের ত্রিশ বৎসর পর অর্থাৎ ৮০ হিজরীতে।

খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর (রা.) এর মর্যাদা এ চারজনের মধ্যে হযরত আবূবকর (রা.) এর পরেই হযরত উমর (রা.) এর স্থান। নবীজী (স.) বিভিন্ন হাদীসে হযরত উমর (রা.) এর মান ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে এভাবে বলেছেন – ‘আল্লাহ তা‘আলা হক্ব ও সত্যকে উমরের উপর মুখ ও অন্তরে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন’ (তিরমিযী-৩৬৮২)। অপর হাদীসে রাসূল (স.) বলেছেন – ‘যদি আমার পরে কেউ নবী হতেন তাহলে উমরই হতেন’ (তিরমিযী-৩৬৮৩)। এ সকল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সাহাবাদের (রা.) মধ্যে বিশেষভাবে হযরত উমর (রা.) কে হক্ব ও সত্য বলার বিশেষ যোগ্যতা প্রদান করেছিলেন। তাই স্বভাবগতভাবেই তিনি সর্বদা সত্য বলতেন। এবং তাঁর সকল কাজ ও সিদ্ধান্ত সঠিক এবং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অনুপাতেই হতো। এ কারণে প্রায় সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হযরত উমর (রা.) এর মতকে স্বয়ং ওহীর মাধ্যমে সত্যতার সনদ দিয়েছেন। হযরত উমর (রা.) এর প্রশংসা এখানে সামান্য আলোচনা করা হলো এজন্যে যে, বিশ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহ‘র নামাজ একই ইমামের ইক্তেদায় জামাতের সাথে মসজিদে নববীতে ধারাবাহিকভাবে আদায় হযরত উমরই (রা.) চালু করেছিলেন। সকল সাহাবা (রা.) তাঁর এই পদ্ধতিকে সমর্থন দেয়ায় এর উপর সাহাবা (রা.) গণের (ইজমা) ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর হযরত উসমান ও আলী (রা.) এই ধারাবাহিকতা বহাল রেখে বিশ্বের সকল উম্মতের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক আমল (সুন্নাতে মুতাওয়ারিছা) হিসেবে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং- উমর (রা.) থেকে আরম্ভ করে খোলাফায়ে রাশেদীনের ধারাবাহিক সুন্নাত, ইজমায়ে সাহাবা দ্বারা (সাহাবাদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে) প্রমাণিত সকল উম্মতের ধারাবাহিক অবিচ্ছিন্ন আমলের মাধ্যমে তারাবীহ বিশ রাকাত সুন্নাহ হিসেবে গৃহীত। এ ছাড়া হাদীসে বিশ রাকাতের কথা উল্লেখ আছে, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তাই আমাদের জন্যও বিশ রাকাতের উপর আমল করা অপরিহার্য। একে যারা বিদ‘আত বা মনগড়া আমল বলবে এবং বিশ রাকাতের কম পড়বে তারাই পথভ্রষ্ট এবং তাদের এ আমল সুন্নাত পরিপন্থি বলেই সাব্যস্ত হবে।

চার ইমামের বক্তব্য

শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) বলেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ। এই চার ইমামের মাঝে প্রথম ইমাম হলেন – ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)। তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ‘র প্রবক্তা (ফাতওয়া কাজিখান- ১/১১২) ইমাম মালিক (রহ.) এর একটি বক্তব্য বিশ রাকাতের পক্ষে, দ্বিতীয় বক্তব্য ৩৬ রাকাতের পক্ষে  (হেদায়াতুল মুজতাহিদ- ১/১৬৭)। ইমাম শাফে‘য়ী (রহ.) বিশ রাকাতের প্রবক্তা (আল-মুগনী ২/১৬৭)। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) এর মোখতার বক্তব্যও বিশ রাকাতের পক্ষে (আল-মুগনী ২/১৬৭)।

আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে হাদীসের উপর আমল করে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ার তাওফীক দান করেন। আমীন।

সৌজন্যে: শায়খুল ইসলাম উলামা সোসাইটি, ওল্ডহাম।

Scroll to Top