‘আস্সালামু আলাইকুম, উসতাদজী। My mamani is organising ‘ladies’ night’, (আমার মামানি নারী রজনীর আয়োজন করতেছেন)’ বলেই সে আমার কাছে একটি লিফলেট দিল। আমি তার দিকে ভালোভাবে তাকালাম। তখন মনে হলো, আমি তাকে অনেক দিন পূর্বে কোথাও দেখেছি। ‘Do I know you? Isn’t your name Maya? (তোমাকে কি আমি চিনি? তোমার নাম কি মায়া [ছদ্ম নাম] নয়?)’ তারপর তার ছোট ভাইয়ের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ‘Yes, this is my brother Ruhel. We used to come to mosque (হ্যাঁ। এ হল আমার ভাই রুহেল [ছদ্ম নাম]। আমরা মসজিদে পড়তে আসতাম)’। কচি মেয়ে। বয়স ন’দশের বেশী হবে না। দেখতেও সে ছোট্ট লাগে। আমি প্রথম যখন শাহজালাল মসজিদের মকতবে শিক্ষাদান শুরু করি তখন সে ও তার ভাই সেখানে পড়তে আসত। দু‘তিন মাস পর অন্য মসজিদে ভর্তি হবার অজুহাত দিয়ে তারা চলে যায়।
লিফলেটটি হাতে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ করলাম। প্রথম পৃষ্ঠার কিছু ছবি দেখেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওদিকে মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। সেদিন ছিল রবিবার। পাঁচ ওয়াক্তের ইমামতি ছিল আমার দায়িত্বে। লিফলেটটি একটি নাচ-গানের পার্টির। বলিউডের মাতাল কিছু আশেকান ও ঢোল-ড্রামের ফটো আছে তাতে। আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘লিসেন, মায়া। ইউ আর এন ইনটেলিজেন্ট গার্ল। আমরা মুসলমান। যে লিফলেটটি তুমি বিতরণ করছ, তাতে নাচ-গানের আসরের দিকে আমন্ত্রণ করা হচ্ছে। সেখানে বলিউডের স্টাইলে কিছু খারাপ বিনোদনের আয়োজন করা হবে। বলিউড হচ্ছে হিন্দু সংস্কৃতির ভাষ্যকার ও প্রচারক। মুসলমান হিসেবে এটা আমাদের জন্য কখনো সমীচিন নয় যে, আমরা অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসরণ করি। এটা মারাত্মক গোনাহ এবং অন্যায় কাজ। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি (ইসলাম ব্যতীত) অন্য কোন সম্প্রদায়ের লোকদের অনুসরণ করে, সে সেই সম্প্রদায়ের একজন বলেই গণ্য হবে। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সে তাদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এখন তুমি আমাকে বলো, তুমি কি হিন্দুদের সাথে জাহান্নামে যেতে চাও?’ এতটুকু নসীহত করেই আমি মসজিদের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।
এটা তো একটি সামান্য দৃষ্টান্ত। বৃটেনে বসবাসরত এরকম শত-শত মুসলমান ঘর আছে যারা বলিউড ছাড়া কিছুই বুঝে না।
আমি যখন জামিয়া ইসলামিয়া বার্মিংহামে পড়াশুনা করতাম, তখন একজন সহপাঠির সম্মানিত মাতার কাহিনী শুনে খুবই মর্মাহত হলাম। সে বলেছিল যে, তার মা বলিউড সিরিয়াল সমূহের এতই পাগল যে, সে যখন টিভির অন্য কোন প্রোগ্রাম দেখার জন্য রিমোট কন্ট্রল হাতে নিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে চায়, তার মা তাকে ধমক দিয়ে সিটিং রুম থেকে তাড়িয়ে দেন। অথচ এই মাতাই তার সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠিয়েছেন ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য। অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে তার ছেলেকে রক্ষা করার জন্য। এ প্রতিকুল সমাজের সব ধরণের বিষাক্ত ছোবল থেকে বাঁচিয়ে একজন সত্যিকারের আলিম ও মুসলমান হিসেবে তৈরী করার জন্য। কিন্তু, আফসোস শত আফসোস! আজ সেই মা সন্তানকে কী শিক্ষা দেবে, যখন সে নিজেই অপসংস্কৃতির লালন-পালনে মত্ত আছে!
অনেক পরিবারে মা-বাপরা সন্তানদের সঠিক সংস্কৃতি ও নীতি-কথা শিক্ষাদান করতে এতই অনিচ্ছুক ও গাফেল যে, ঘন্টার পর ঘন্টা তারা হিন্দি সিরিয়াল দেখতে মগ্ন। টিভির পর্দায় দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে উঠছে, আর তারা সেখানে বসেই আছেন। দুনিয়ার কোন খবরাবর নেই। আশ-পাশে কী হচ্ছে? নিজের সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, পেশাব-পায়খানা কোনো কিছুর দিকেই লক্ষ্য নেই। তাদের মতে, নাথিং ইজ মোর ইমপর্টেন্ট দ্যান হিন্দি সিরিয়ালস।
কিছুদিন পূর্বে সাত বছরের একটি ছোট্ট মেয়ের অবস্থা দেখে তো আমি হতবাক। সে আমার রুমে প্রবেশ করা মাত্রই বানরের মত লাফাতে লাগল, আর সাথে সাথে হিন্দিতে কি যেন গুনগুন করছিল। ওর মা নিচতলায় বসে আমার আম্মার সাথে আলাপ করতেছেন। আমি তাকে বললাম, হেই! তুমি এরকম লাফাচ্ছ কেন? জবাবে সে বলল, I want to be like a Bollywood actress (আমি বলিউডের একজন অভিনেত্রীর মত হতে চাই)।
এ কথা শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। পিচ্ছি মেয়ে কী বলে!
আমি যখন কলেজে যেতাম তখন আমার ক্লাসে একটি সোমালি মেয়ে পড়ত। সে হিন্দি ফিল্মসমূহের এতই আশেক ছিল যে, সে সোমালিয়ান হওয়া সত্তে¡ও হিন্দি ভাষা বুঝতে পারত এবং হিন্দিতে কথা বলত। একবার ক্লাসের অন্যান্য এশিয়ান ছেলে-মেয়েরা একটি হিন্দি ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করছিল। সে বলল, I watched that film three times and every time I cried (আমি ঐ ফিল্মটি তিনবার দেখেছি, আর প্রতিবারই আমি কেঁদেছি)। ঘটনাক্রমে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি সেই ফিল্ম দেখেছি কিনা। আমি এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ, একদিকে আমি ছিলাম একজন মৌলভী, আর অন্যদিকে হিন্দি কালচারের প্রতি ছিল আমার তীব্র ঘৃণা। আমি বললাম, I hate Hindi films from the bottom of my heart (আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে হিন্দি ফিল্মসমূহকে ঘৃণা করি)।
আমার এক বন্ধু একবার বললেন, বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে বোধ হয় যেন হিন্দি ফিল্মের কোন এক দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আমরা বাস্তবিক অর্থে বলিউডের মানসিক ও সাংস্কৃতিক গোলামে পরিণত হয়ে গেছি। আমাদের না আছে বিবেক, না আছে আত্মসম্মানবোধ। আমরা আমাদের আত্মপরিচয়কে সমূলে বিসর্জন দিয়ে আপাদমস্তক একটি ভীন্ন জাতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছি। ফুলের মত নিষ্পাপ কচি কচি ছেলেমেয়েদেরকে এসব অপসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে। ছোট ছোট শিশুরা অশ্লীল হিন্দি গানসমূহ রপ্ত করে নিজেদের ভবিষ্যৎকে বিনাস করছে।
বিজাতির অনুসরণ ও অনুকরণ বুদ্ধিমান মানুষের চরিত্র নয়। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এটা বানর জাতির বিরল বৈশিষ্ট। বৃটেনে অবস্থানরত আমার সম্মানিত উস্তাদ মুফতি আব্দুল মুনতাকিম সাহেব এ সম্পর্কে একটি চমৎকার গল্প শুনান।
একবার এক দরিদ্র ব্যক্তি টুপি বিক্রি করার জন্য বাজারের দিকে রওনা হয়। পথিমধ্যে বিশ্রাম করার জন্য সে একটি বৃক্ষের নিচে অবস্থান করে। তার মাথায় ছিল একটি রঙ্গিন টুপি। টুপির বক্সটি পাশে রেখেই সে শুয়ে পড়ে । ঘটনাক্রমে যে বৃক্ষের নিচে সে অবস্থান করছিল তার উপর কিছু সংখ্যক বানরের দল ওঁৎ পেতে বসেছিল। বানররা যখন দেখে যে, ব্যক্তিটি টুপি পরিধান করে আছে এবং টুপির বক্সটির ভিতরের টুপিগুলো দেখা যাচ্ছে, তখন তারা কোন কিছু চিন্তা না করেই কেবলমাত্র ঐ ব্যক্তির নকল করার জন্য এক এক করে বক্সের সবক’টি টুপি নিয়ে যায়। সেগুলি মাথায় দিয়ে তারা পুণরায় বৃক্ষের উপর চড়ে যায়।
নিদ্রা থেকে জেগে তো দরিদ্র বেচারা হতবিহ্বল। মারাত্মক দুশ্চিন্তা তার মাথায় চড়ে বসে। কোথায় যে তার সবক’টি টুপি উদাও হয়ে গেল। কোথায় গেল তার একমাত্র সম্বল? কে নিল? কোন পাত্তা নাই। হতাশায় অগত্যা সে তার নিজের মাথায় পরিহিত একমাত্র টুপিটিও ছুঁড়ে ফেলে। এ অবস্থা দেখে গাছের উপর অবস্থানরত বানরগুলোও তার অনুসরণ করে তাদের টুপিগুলো একটা একটা করে নিচে ফেলতে লাগে। এখনতো দরিদ্র বেচারা আবেগে আপ্লুত। কীভাবে যেন আকাশ থেকে তার টুপিগুলো বৃষ্টির ন্যায় বর্ষাতে লাগল!
বানরগুলো না বুঝেই টুপিগুলি পরিধান করেছিল, আবার না বুঝেই সেগুলি খুলে ফেলে।
আল্লাহ সুবহানাহু ও তায়ালা আমাদের সবাইকে সুমতি দান করুন। আমীন।
আব্দুল্লাহ ফাহীম
১২.৪.২০১৩ ইংরেজী