কিয়ামতের আলামতসমূহ

কিয়ামতের আলামতসমূহ

মানুষের হিসাবনিকাশের সময় আসন্ন, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। (আল-কোর‘আন: সূরা আম্বিয়া-১)

কিয়ামত দিবস প্রতিনিয়তই নিকটবর্তী হয়ে আসছে। হযরত সাহল বিন সা‘দ (রাযি:) বর্ণনা করেন যে, তিনি আল্লাহর রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাহাদাত (তর্জনী) আঙ্গুলের দিখে ইশারা করে বলতে প্রত্যক্ষ করেছেন,“আমাকে এবং কিয়ামত দিবসকে এরকম (নিকটবর্তী) করে পাঠানো হয়েছে।” (অর্থাৎ যেভাবে তর্জনী এবং মধ্য আঙ্গুল তেমন দূর নয়, সেভাবে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)‘র আগমন এবং কিয়ামত দিবস তেমন দূর নয়)। উল্লেখ্য যে, এ বাণীটি ছিল চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে। সুতরাং আমাদের সময়ের থেকে কিয়ামত যে কত নিকটবর্তী- তা সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে।   

কিয়ামত কতটুকু নিকটবর্তী- সেটা নির্ণয় করার জন্য কিছু আলামত আছে, যেগুলোকে আবহমানযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই আলামতগুলো দু‘ভাগে বিভক্ত:

১)       ছোট আলামতসমূহ

২)      বড় আলামতসমূহ

এখানে আমি গু’টি কয়েক ছোট আলামতসমূহ উল্ল্যেখ করব যেগুলো আমাদের সময়ের সাথে সম্পৃক্ত- যাতে করে আমরা আমাদের লাইফষ্টাইলের প্রতি একটু নজর বুলিয়ে নিতে পারি এবং সেটাকে সংশোধন করতে উদ্বুদ্ধ হই। 

১)       বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হবে।

“শীঘ্রই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন দিক থেকে পরস্পরে একে অপরকে তোমাদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করবে, যেভাবে ভোজনকারীরা (আহারকারী) একে অপরকে থালার দিকে আহবান করে।” ঐতিহাসিকভাবে তাতাররা ও ক্রুসেডাররা মুসলিম দেশগুলোর উপর হামলা চালিয়েছে, এবং সম্প্রতি অবৈধ ইরাক যুদ্ধ, ফিলিস্তিনীদের উপর পাশবিক নির্যাতন এবং আফগানিস্তানের উপর বেআইনী হামলা- এই হাদীসটির মর্মবাণীকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে দেয়।  

২)       যিনা-ব্যভিচার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।

যিনা-ব্যভিচার এ সমাজে মহামারীর রূপ ধারণ করে নিয়েছে। সাথে সাথে স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট ও কর্মস্থলে অশ্লীলতা ও বেহায়পনার ছড়াছড়ি এগুলোকে হারাম-অবৈধ সম্পর্ক ও অন্যান্য রকমারী গোনাহের উর্বর ভ‚মিতে পরিণত করেছে। অত্যন্ত পীড়াদায়ক বিষয় হচ্ছে যে, মুসলমানরাও এ জঘন্য গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েছে- যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।   

৩)       নগ্ন নারীরা পুরুষের জন্য গোনাহের ফাঁদ বিস্তর করবে।

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুই ধরণের লোকদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে। দ্বিতীয় গ্রæপের মধ্যে হচ্ছে- “ঐ সমস্ত নারীরা যারা পোশাক পরিহিত অবস্থায় নগ্ন থাকবে  (পোশাক এত স্বল্প, স্বচ্ছ (transparent) বা টাইট যে- অধিকাংশ দেহই অনাবৃত থেকে যায়)। তারা পুরুষদেরকে গোনাহের প্রতি আহবান করবে এবং পুরুষরাও তাদেরকে গোনাহের দিকে আহবান করবে। তাদের মাথার চুল হবে দীর্ঘ গর্দানবিশিষ্ট উটের কুঁজের মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবেনা; জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা। যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে।” (সহীহ মুসলিম)

এ ভবিষ্যদ্বাণীটি আমাদের যুগে খুব বেশী প্রতীয়মান। অবহেলাকারী মুসলমান পিতা, স্বামী, ভাই এবং অভিভাবক যারা তাদের মহিলাদেরকে এভাবে পোশাক পরতে অনুমোদন/উদ্বুদ্ধ করে- তারা এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের নামাজ-রোজা, জাহিরী তাকওয়া, হজ্জ-ওমরা আমাদেরকে যেন প্রতারিত না করে- অন্যদিকে যখন আমাদের মহিলারা রাস্তা-ঘাটে উত্তেজনামূলক বস্ত্র পরে রাস্তার পুরুষকে গোনাহের প্রতি আহবান করে। এই হাদীসে ঐ সমস্ত তথাকথিত হিজাবী মেয়েদের জন্যও সতর্কবাণী রয়েছে যারা খুবই টাইট ও আকর্ষণীয় কাপড় পরে এবং তাদের চুলকে উটের কুঁজের মত বানিয়ে রাখে। 

৪)      সর্বত্র সুদের লেনদেন ছড়িয়ে পড়বে।

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, “অবশ্যই মানুষের উপর এমন এক সময় আসবে যখন একজন ব্যক্তি লক্ষপাত করবেনা যে কোথায় থেকে সে তার সম্পদ অর্জন করেছে- সে কি হালাল পন্থায় উপার্জন করেছে না হারাম পন্থায়?” (সহীহ বুখারী)

অনেক মুসলমানরা তাদের উপার্জনের মধ্যে হালাল-হারামের কোন পার্থক্যই করেনা। সাথে সাথে দৈনন্দিন লেনদেনে সুদের ব্যাপক ব্যবহার পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে।

সুদের লেনদেন যে কত বড় গোনাহ তা এ থেকে বুঝা যায় যে- স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা সুদ-লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। 

৫)       মিউজিক ও গায়িকাদের ব্যাপকতা। 

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন যে, “শেষ যুগে ভূমিধ্বস (Earthquake) বেড়ে যাবে, পাথর-বৃষ্টি ঘটবে এবং অনেক চেহারা বিকৃত হয়ে যাবে।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “সে সময় কবে আসবে?” নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাবে বললেন, “যখন বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকারা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়বে।” (সুনান ইবনে মাজাহ)

লাইভ শো হোক বা টিভির পর্দা হোক- বর্তমানে এ আলামত আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঐ সমস্ত মাতা-পিতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন যারা ঘন্টার পর ঘন্টা অশ্লীল দৃশ্য ও নৃত্য এবং নির্লজ্জ গায়িকাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন- তারা আল্লাহর গযবকে ভয় করা উচিত! নিশ্চয়ই টিভি দেখার সময় চক্ষু, কান ও অন্তরের ব্যভিচার সংঘটিত হচ্ছে। 

৬)       মাতার অবাধ্যতা।

“যখন স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আনুগত্য করবে এবং তাদের মাতাদেরকে হয়রানি করবে।”

দুঃখজনকভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণীটিও মুসলমান পরিবারগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে। নমনীয় স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের ইশারায় উঠা-বসা করেন। অন্যদিকে তারা তাদের মার সাথে কঠোর ব্যবহার করেন। এ সকল স্বামীদের জ্ঞাত থাকা উচিত যে, মাতার অবাধ্যতা একটি কবীরা গোনাহ।  

৭)        পারিবারিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা।

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, “কিয়ামতের পূর্বে পারিবারিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা বৃদ্ধি পাবে।” (মুসনাদে আহমাদ)

আজকাল আমাদের পরিবারগুলোতে যৎসামান্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। আন্তরিক সম্পর্ক যেন বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলো পরস্পরে দূরে থাকে। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ভালবাসা উদাও হয়ে গেছে। হয়ত মাল-সম্পদ ও অহঙ্কার- এ পরিস্থিতি তৈরীতে ইন্দন যুগিয়েছে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন!

৮)       ভূমিকম্পের বৃদ্ধি পাওয়া।

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, “কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত আসবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত বেশী বেশী ভ‚মিকম্প হবেনা।” সম্প্রতি ভয়ঙ্করভাবে ভ‚মিকম্পের বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিয়তই বিশাল ভূমিকম্প শহর-বন্দরগুলোকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে। আর এগুলো হচ্ছে আমাদের প্রতিপালকের অবাধ্যতার প্রতিফলন।  

এই আলামতগুলো যেভাবে সতর্কবাণী তেমনিভাবে মহান আল্লাহর অসীম দয়ার নিদর্শন, যদ্বারা তিনি আমাদেরকে বিচার দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার দিকে আহবান করছেন। যে দিন আমাদের সম্পদ, মাতা-পিতা ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবেনা। তাই এখনই হচ্ছে সময় সে প্রস্তুতি গ্রহণ করার। কারণ, আমাদের জানা নয় কখন আমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হব। আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য তওবা করা উচিত। আমাদের ফরজ কর্তব্যগুলো আদায় করার জন্য উঠেপড়ে লাগা উচিত। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যাকাত, রোজা ও হজ্জ বিনা দ্বিধায় আদায় করা উচিত। বোনেরা সত্যিকারের হিজাব পরা উচিত। আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের আগামী প্রজন্ম শিশুদের ইসলামী শিক্ষা-দিক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে- যাদের বিষয়ে আমাদেরকে কিয়ামত দিবসে জিজ্ঞেস করা হবে। আমাদেরকে অবশ্যই সবধরণের গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, যেমন – টিভিতে হারাম (হিন্দি) প্রোগ্রামগুলো দেখা, হারাম (হিন্দি) গান/মিউজিক শুনা, মদ, ড্রাগ, ব্যভিচার, জোয়া, অনৈসলামিক পোশাক পরা, গীবত, মিথ্যাচার ইত্যাদি। 

উভয় জাহানে আমাদের সাফল্য আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্যের মধ্যে নিহিত। অন্যদিকে তাঁদের অবাধ্যতা আমাদের পতন বৈ কিছু আনবেনা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উপরোক্ত আলামতগুলো থেকে উপদেশ গ্রহণ করার এবং তওবা করে আমাদের জীবনকে পুণরায় তাঁর আদেশানুযায়ী গড়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

মূল: শায়খ সারফরাজ

অনুবাদ: মাওলানা আব্দুল্লাহ ফাহীম

৫.৯.২০১৩

Scroll to Top