যখন শা‘বান মাস আসে, তখন এক ধরণের লোক শুধুমাত্র ১৫ ই শা‘বানকে উদযাপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে তারা শা‘বান মাসের অন্যান্য ফজিলতবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেন। আসুন আমরা শা‘বানের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদীস শরীফে কী এসেছে – তা একটু পরীক্ষা করে নেই। সাথে সাথে ১৫ ই শা‘বানের সীমানাটুকুও জেনে নেই, যাতে করে আমরা আল্লাহর প্রিয় নবীর প্রদর্শিত জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করে মহান আল্লাহর আনুগত্য করতে পারি।
(১) আম্মাজান আয়িশা (রাযি:) বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে রামাজান ব্যতীত অন্য কোন মাসের প্রতিটি দিন রোজা রাখতে দেখিনি, এবং আমি তাঁকে শা’বান মাসের মত অন্য কোন মাসে এত বেশী রোজা রাখতেও দেখিনি। তিনি আরো বলেন, (নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত বেশী রোজা রাখতেন) যেন তিনি শা‘বানের পুরো মাসই রোজা রাখতেন। (দেখুন: বুখারী ১৯৬৯, মুসলিম ১১৫৬, মিশকাত ২০৩৬)। আবূ হুরাইরা (রাযি:) বর্ণনা করেন যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, রামাজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য শা‘বানের চাঁদকে গণনা করতে থাক। (দেখুন: তিরমিযী ৬৮৭, দার কুতনী ২১৫৪)
(২) উসামা ইবনে যাইদ (রাযি:) বর্ণনা করেন যে, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলাম, ও আল্লাহর নবী! আমি দেখি আপনি শা‘বান মাসে এত বেশী রোজা রাখেন যা আপনি অন্য কোন মাসে রাখেন না? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাবে বললেন, শা‘বান হল এমন একটি মাস যাকে অনেক লোক অবহেলায় কাটিয়ে দেয়। এটা এমন একটি মাস যাতে বান্দাদের আমলসমূহ মহান আল্লাহর দরবারে উত্তোলন করা হয়। আমি চাই যে আমার আমলসমূহ এমন অবস্থায় আল্লাহর দরবারে উত্তোলন করা হোক যখন আমি রোজা রাখি। (দেখুন: নাসায়ী ২৩৫৯, আহমদ ৫/২০১)
(৩) আবূ যর গিফারী (রাযি:) বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ও আবূ যর! তুমি যদি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতে ইচ্ছা করো, তাহলে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখবে। (দেখুন: তিরমিযী ৭৬১, নাসায়ী ২৪২২)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি:) বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে হোন বা সফরে হন, আইয়ামুল বীযের (অর্থাৎ প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) রোযাগুলি কখনো ছাড়তেন না। (দেখুন: নাসায়ী ২৪১৫, মিশকাত ২০৭১)
অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হল যে, অধিকাংশ লোক শা‘বান মাসে রোযা রাখার ফজিলত সম্পর্কিত উল্লিখিত সহীহ হাদীসগুলো সম্পর্কে অবগত নয়।
১৫ ই শা‘বান সম্পর্কিত হাদীসসমূহ
উল্লেখ্য যে, ১৫ ই শা‘বান সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র একটি হাসান (গ্রহণযোগ্য) হাদীস পাওয়া যায়। আর বাকিগুলো হয়ত যায়ীফ (দুর্বল) অথবা মওযূ (বানোয়াট)। উপরন্তু, হাদীসের ছয়টি সহীহ কিতাবগুলোর মধ্য থেকে শুধুমাত্র তিরমিযীতে একটি যয়ীফ হাদীস এবং ইবনে মাজাহতে দু’টি যয়ীফ এবং একটি বানোয়াট হাদীস পাওয়া যায়। বাকী চারটি কিতাবে ১৫ ই শা‘বান সম্পর্কে কোন হাদীস বিদ্যমান নেই।
(১) আম্মাজান আয়িশা (রাযি:) বর্ণনা করেন যে, এক রাত্রিতে আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে হারিয়ে ফেললে তাঁর খুঁজে আমি বের হলাম। হঠাৎ দেখলাম তিনি আল-বাকীতে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, হে আয়িশা! তুমি কি মনে করেছ যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলম করবেন? আমি জবাবে বললাম, ও আল্লাহর নবী! আমি ধারণা করেছি যে আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর নিকট গিয়েছেন। তারপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শা‘বান মাসের মধ্যবর্তী রাত্রিতে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হোন এবং কালব গোত্রের ছাগলগুলোর চেয়ে অধিক সংখ্যার লোকদেরকে ক্ষমা করেন। (তিরমিযী ৭৩৯, ইবনে মাজাহ ১৩৮৯। এ হাদীসটিকে মুহাদ্দিসগণ যয়ীফ বলে আখ্যায়িত করেন।)
অনেক লোক এ হাদীস দ্বারা ১৫ ই শা‘বানের ফজীলত এবং তাতে কবর জিয়ারত করার বিষয়টি প্রমাণ করতে চান। কিন্তু নিম্নোক্ত বিষয়গুলি দ্রষ্টব্য:
-
এটা একটি দুর্বল হাদীস। এটাকে সহীহ বা হাসান হাদীসের গুরুত্ব দেয়া যায় না।
-
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাকী কবর জিয়ারত করেছেন, দল বেঁধে নয়।
-
তিনি কবর জিয়ারত করেছেন রাত্রিবেলা, ১৫ ই শা‘বানের পূর্ববর্তী দিনে নয়।
-
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা জীবনে শুধু একটিবার এ আমল করেছেন। এটা হুজুরের কোন নিয়মিত আমল ছিল না।
-
১৫ ই শা‘বানকে অনেক লোক উৎসবের মত উদযাপন করেন। অথচ এ হাদীসের আলোকে শুধুমাত্র একাকী ইবাদতের বিষয়টিই বুঝা যায়।
(২) আলী ইবনে আবূ তালিব (রাযি) বর্ণনা করেন যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, যখন ১৫ ই শা‘বানের রাত আসে, তখন রাত্রি জাগরণ করে নামাজ পড় এবং পরদিন রোজা রাখ। কারণ, এ রাত্রিতে সূর্যাস্থের পর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হোন এবং আওয়াজ দেন, আছে কেউ ক্ষমাপ্রার্থী! যাকে আমি ক্ষমা করে দিই; আছে কেউ রিযকপ্রার্থী! যাকে আমি রিযক দান করি; আছে কেউ বিপদগ্রস্থ! যাকে আমি বিপদ থেকে মুক্তি দান করি। এ আওয়াজ আসতে থাকে ফজর পর্যন্ত। (ইবনে মাজাহ ১৩৮৮, তাহযীবুল কামাল ৩৩/১০৭)
হাদীসটি সম্পর্কে কিছু কথা:
-
হাফিয আল বুসাইরী তার যাওয়াইদে ইবনে মাজাহ নামক কিতাবে এ হাদীসটিকে অত্যন্ত দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
-
অনেক স্কলাররা এ হাদীসটিকে বানোয়াট বলেছেন।
-
যদি হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য মানাও যায়, তাহলে শুধু একাকী ইবাদত করা প্রমাণিত হয়, উৎসব উদযাপন তো প্রমাণিত হয় না!
(৩) আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযি:) বর্ণনা করেন যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ১৫ ই শা‘বানের রাত্রিতে মাখলূকদের প্রতি লক্ষ্য করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ ১৩৯০, ইবনে হিব্বান ৫৬৬৫, বাইহাক্বী ৩/৩৮২)
হাদীসটি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা:
-
সহীহ ইবনে হিব্বান এবং সহীহ ইবনে খুযাইমাতে বিদ্যমান হাদীসগুলি তখনই সহীহ গণ্য করা হয় যখন মুহাদ্দিসগণ এগুলোকে সহীহ আখ্যায়িত করেন, এবং উপরোক্ত হাদীসটিকে হাসান বলে গণ্য করা হয়েছে।
-
এ ইস্যু সম্পর্কে এটাই হল একমাত্র হাদীস যা হাসান লিগাইরিহ। অর্থাৎ একাকী প্রতিটি সনদই দুর্বল, তবে কয়েকটি সনদ একসাথে মিলে হাসান হয়ে যায়। (এ হাদীসটির বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবূ বকর, মু‘য়ায ইবনে জাবাল, আবূ ছা‘লাবা আল খুশানী, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আবূ হুরাইরা, ‘আউফ ইবনে মালিক, এবং আম্মাজান আয়িশা (রাযি:) এর নাম পাওয়া যায়।)
-
ইমাম বাইহাকী (রাহ:) এ হাদীসটিকে শু‘য়াবুল ঈমান গ্রন্থে (৩/৩৮২) আম্মাজান আয়িশা (রাযি:) থেকে বর্ণনা করেছেন। যাতে আছে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত দীর্ঘ সাজদাহ করলেন যে আমার মনে হল তিনি ইন্তেকাল করেছেন ….অতপর তিনি উল্লিখিত পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন। এ হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে একজন ব্যক্তি এ রাত্রিতে দীর্ঘ নামাজ পড়তে পারবেন, যদিও বাইহাকীর এ বর্ণনাটি দুর্বল।
-
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রির নামাজ স্বীয় পরিবারের সদস্যদের না জাগিয়ে একাকী পড়তেন।
উপসংহার
(১) যেহেতু ১৫ ই শা‘বান সম্পর্কিত হাদীসগুলি তেমন নিখুঁত নয়, তাই এ-র উপর সীমাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করা উচিত নয়। তেমনিভাবে এটাকে বিদআত ঘোষণা করা বা এ-র প্রমাণিত ফজিলতসমূহকে অস্বীকার করাও ঠিক নয়। কারণ, একটি হাসান (গ্রহণযোগ্য) হাদীস এ-র ফজিলতসমূহকে প্রমাণ করে।
(২) যদি কেউ একাকী এ রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হন, তাহলে তাতে কোন অসুবিধা নেই; যেহেতু কিছু দুর্বল রেওয়াতসমূহে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। তবে দলে দলে এক সাথে জড়ো হয়ে ইবাদত করা সাহাবা, তাবি‘য়ীন বা আতবায়ে তাবি‘য়ীনের মধ্য থেকে কারও কাছ থেকে প্রমাণিত নয়।
(৩) কবর জিয়ারত সম্পর্কিত হাদীসটি খুবই দুর্বল। সুতরাং প্রতি বৎসর দলে দলে কবর জিয়ারত করা, কবরস্থানে গিয়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা, এবং ১৫ ই শা‘বানের রাতের পূর্বে কবর জিয়ারত করা বিদআত বলে গণ্য হবে। কোন বিদআতের উপর আমল করা কবীরা গুনাহ (মহাপাপ)।
(৪) লোকদেরকে আহবান করে মসজিদে জমায়েত হওয়া, এ উপলক্ষে মসজিদকে সুসজ্জিত করা, ফায়ার ওয়ার্কস এবং মোমবাতি প্রজ্বলিত করা, এবং খাবার বন্টন করা – এগুলোর কোন কিছুই রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ বা সালাফে সালিহীনের আমলের দ্বারা প্রমাণিত নয়।
(৫) আইয়ামুল বীযের হাদীসের আলোকে ১৫ ই শা‘বানে রোযা রাখা বৈধ। তবে শুধু ১৫ ই শা‘বানে রোযা রাখা সম্পর্কে আলী (রাযি:) থেকে যে হাদীস বর্ণিত, তা অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট।
(৬) হানাফী মাযহাবের গ্রন্থসমূহ, যেমন নূরুল ঈযাহ বা মুখতাসারুল কুদুরীতে শুধুমাত্র ১৫ ই শা‘বানে রোযা রাখার বিষয়টি উল্লেখ নয়। কারণ ঐ হাদীসগুলো সহীহ নয়।
(৭) ১৫ ই শা‘বানের রাত্রিকে ‘লাইলাতুল বারাআহ’ বলে নাম দেয়া সহীহ হাদীসগুলি দ্বারা প্রমাণিত নয়।
(৮) সূরা দুখানের ৩য় এবং ৪র্থ আয়াতকে ১৫ ই শা‘বানের ফজিলত প্রমাণের জন্য দলীল হিশেবে পেশ করা হয় যে এ রাত্রিতে প্রতিটি মানুষের তাকদীর লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রথমত, এটা শুধু ইমাম ঈকরিমার রায়, যিনি একজন তাবিয়ী ছিলেন। অধিকাংশ সাহাবা ও তাবি‘য়ীনের মতে আয়াতের উদ্দেশ্য হল লাইলাতুল কদর। দ্বিতীয়ত, যদি ১৫ ই শা‘বানের রাত উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হয়েও থাকে, তবুও এর দ্বারা এ রাত্রিতে সীমাতিরিক্ত আমলসমূহের বৈধতা প্রমাণিত হয় না।
(৯) হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্থসমূহ, যেমন নূরুল ঈযাহে উল্লেখ আছে, এ রাত্রিতে মসজিদে জমায়েত হওয়া মাকরূহ (অপছন্দনীয়)। (নূরুল ঈযাহ ৮০, বৈরুত প্রিন্ট)
(১০) সায়্যিদ ইউসুফ বিননুরী (রাহ:) তিরমিযী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ মা‘আরিফুস সুনানে লেখেন, হাফিজ সুয়ূতী, আবূ তালিব মক্কী, ইমাম গাজালী এবং শায়খ আব্দুল কাদীর জিলানী ১৫ ই শা‘বানের ফজীলত সম্পর্কে কিছু দুর্বল ও অগ্রহণীয় রেওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন। এগুলোর সবক’টিই ভিত্তিহীন।
(১১) পরিশেষে, দয়া করে বিষয়টি মুক্তচিত্তে, নিষ্ঠার সাথে অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন। এটাকে হানাফী-সালাফী ইস্যু বলে গণ্য করবেন না।
শায়খ ফায়যুলহক আব্দুল আযীয
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া বার্মিংহাম
ভাষান্তরে: আব্দুল্লাহ ফাহীম