খ্যাতিমান আমেরিকান বাস্কেট বল খেলোয়াড় ক্রিস জ্যাকসনের ইসলাম গ্রহণের উদ্দীপনামূলক কাহিনী সত্যিই পাঠ করার উপযুক্ত। তার ইসলাম পরবর্তী নাম হল মাহমূদ আব্দুর রাঊফ।
ক্রিস জ্যাকসনের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী কী রকম? এবং কীভাবে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন?
আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা
গত তিন দশক যাবত হাজার হাজার আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাদের অনেকেই বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গ আবার অনেকেই সাধারণ নাগরিক। যেহেতু ইসলাম হল- সাম্যতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সামাজিক ন্যায়-বিচারের ধর্ম এবং রঙ ও বর্ণের দরূন নিপীড়ন ও বৈষম্যতাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করে- তাই ইসলামকে নিজের ধর্ম হিশেবে গ্রহণ করতে তারা দ্বীধাবোধ করেন নি।
আর যেহেতু এই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা তাদের ঈমানী অভিযাত্রায় শুধু আধ্যাত্মিক মুক্তিই তালাশ করছিলেন না, বরং তাদের টার্গেট ছিল এমন এক দ্বীনকে আলিঙ্গন করা যা তাদের মানুষিক মর্যাদা রক্ষা করার সাথে সাথে তাদের কালো বর্ণকেও হেয় করবে না। এবং তাদের সে লক্ষ্য শুধুমাত্র ইসলামের সুমহান ন্যায় ও সাম্যতার ছায়াতলে এসেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
ইসলাম তাদের অন্তরে আশার আলো ছড়ায় এবং ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দেয়। যখন তারা ইতিহাস পড়েন, তখন ইসলামের সাম্যতার বাণী তাদেরকে মুগ্ধ করে। যে সাম্যতা বিলাল হাবাশী, সুহাইব রূমী, সালমান ফারসী ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছিল, এবং যার কারণে এ সমস্ত মহান ব্যাক্তিরা আল্লাহর উপর ঈমান ও রাসূলের প্রতি অগাধ বিশ্বাসকারীদের কাতারের অগ্রনায়ক ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ক্রিস জ্যাকসন সর্বদা চিন্তা করতেন যে – আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীড়া ও শিল্পজগতে যতই খ্যাতি অর্জন করে নেয় না কেন, তাদের কিন্তু কোন নিয়মিত সংগঠন ছিল না; যে সংগঠন মানবতা ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন নিশ্চিত করবে, উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করবে, এবং অপরাধ ও নেশাদ্রব্যকে পরিহার করে উত্তম চরিত্রের সাথে জীবনযাপনের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করবে। এমনই একটি জীবনব্যবস্থার অনুসন্ধানে, যা তার নিজের ও গোত্রীয় ভাইদের মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়ন করবে- ক্রীস জ্যাকসনেরই ঈমানী যাত্রার সূচনা হয়।
তাইতো ইসলাম গ্রহণ করে এ সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানরা অবিচলতা ও নিষ্ঠার সাথে তাদের ধর্ম প্রদর্শিত পথে চলতে থাকেন এবং নিজেদের ও নিজ সন্তান-সন্ততির জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধশালী উজ্জল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে সদা কাজ করতে থাকেন।
অবস্থার উন্নতি ও শক্তির বিস্ফোরণ
ক্রিস জ্যাকসন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা প্রথমে তাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে হবে, যাতে করে তারা তাদের নিজেদের সমাজকে উন্নত স্তরে পৌঁছাতে পারে। এ জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা লোকদের মধ্যে আশার আলো ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উত্তম চরিত্র গঠন করা ও সন্দেহের স্থানগুলো থেকে দূরে থাকার দিকে আহবান করতে হবে। এবং অবশেষে শিক্ষা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আমেরিকান সমাজে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করতে হবে।
তাই ক্রিস জ্যাকসন এমন এক জীবনব্যবস্থার তালাশ করাকে অপরিহার্য বোধ করছিলেন- যা তাকে সরল ও সঠিক পথ প্রদর্শন করবে। সাম্যতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সম্বন্ধে তার হতবুদ্ধিকর প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদান করবে। ফলে তাকে তার মানবতাবোধ উজ্জেবিত করবে এবং এ জগতে কামিয়াবী অর্জনের লক্ষ্যে তার গুপ্ত মেধার বিকাশ ঘটাবে।
ঈমানী অভিযাত্রা
আর এখান থেকেই জ্যাকসনের ঈমানী অভিযাত্রার সূত্রপাত ঘঠে। ইসলামী জীবনব্যবস্থায় বিদ্যমান স্বাধীনতা, মর্যাদা, সাম্যতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার তাকে বিমুগ্ধ করে দেয়। তিনি যেন তার হারানো জহরত ফিরে পেয়েছেন। ফলে তিনি তা আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে লাগেন। ধীরে ধীরে তার অন্তর ঈমানের নূরে আলোকিত হতে লাগে। আল্লাহ তাআলা তার অন্তরকে সত্য ও হেদায়াত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন। ইসলাম যে একমাত্র সত্য জীবনব্যবস্থা – তাতে জ্যাকসনের আর কোন সন্দেহ বাকি থাকে না। ফলে ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা নিজেকে মাহমূদ আব্দুর রাঊফে রূপারন্তরিত করে নেন।
জাতীয় সংগীতের জন্য দাড়ানো
১৯৯৬ সালে মার্চে বাস্কেট বল প্লেয়ার মাহমূদ আব্দুর রাঊফ আমেরিকান মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের শুরুতে যখন সকল খেলোয়াড়রা আমেরিকান জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের সম্মানে দাঁড়াতে লাগলো তখন তিনি তা করতে অসম্মতি জানান। ফলে তাকে আমেরিকার জাতীয় বাস্কেট বল ক্লাব থেকে সাস্পেন্ড করে দেয়া হয়। জাতীয় বাস্কেট বল ক্লাবের সাথে সংঘাত কোন সাধারণ ক্রীড়াবিষয়ক সংঘাত ছিল না। বরং আব্দুর রাঊফের বিশ্বাস অনুযায়ী, এ দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম ও আমেরিকান জাতীয় পারষ্পরিক সাংঘর্ষিক দু‘টি প্রত্যয়।
নিপীড়নের প্রতীক
মাহমূদ আব্দুর রাঊফ আমেরিকান পতাকার জন্য তার দাড়ানোতে অনিচ্ছার কারণ বর্ণনা করেন যে, আমেরিকান পতাকা হল নিপীড়নে ও অন্যায়ের প্রতীক। তাই তিনি জাতীয় বাস্কেট বল আয়োজিত সেই ম্যাচে সম্মানার্থে দাঁড়াতে অসম্মতি জানান। সে ঘটনার পর থেকে আমেরিকান জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত আবৃত্তি শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি চ্যাঞ্জ রুমে বসে থাকেন অথবা জুতার ফিতা লাগানো ভান করে ষ্ট্যাডিয়ামের বাহিরে অবস্থান করেন।
আব্দুর রাঊফের বার্ষিক আয় হল প্রায় ২,৬ মিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, আমার কাছে আমার ধর্ম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি চাই যে, সর্বদা আল্লাহর প্রতি আমার আনুগত্য অন্যান্য জিনিসের চেয়ে বেশী হোক।
সাস্পেন্সন অব্যাহত থাকাকালীন অবস্থায় আব্দুর রাঊফ প্রতিটি ম্যাচে প্রায় ৩১,৭০৭ ডলার লোকসান উঠান। আব্দুর রাঊফ বলেন, আমার সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার দায়িত্ব অন্য কোন জাতীয়তাবাদী চিন্তা-ধারা থেকে হাজারগুন বেশী।
দ্বীনী ইখলাছ
আমেরিকান জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার সম্বন্ধে তার অবস্থান- তার সহকর্মী বাস্কেট বল খেলোয়াড়দেরকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়। বিরোধীতাকারীর বলেন যে, সম্মানার্থে দাড়ানো ইসলামের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। অন্যদিকে আমেরিকার সবচেয়ে দামী বাস্কেট বল খেলোয়াড় শোকেল অনেল বলেন, প্রত্যেক মানুষের ভীন্নজাত বিশ্বাস রয়েছে- যা আমাদের উচিত সম্মান করা। আব্দুর রাঊফের সহকর্মী লা ফন্সো আলিছ যিনি তার সাথে নেগটিছ বাস্কেট বল ক্লাবে একসাথে খেলতেন – বলেন, আমরা যারা খৃস্টান ধর্ম অনুসরণ করি তাদের উচিত হল আব্দুর রাঊফের মত তাদের ধর্মের প্রতিও পুরোপুরি নিষ্ঠাবান হওয়া।
(আরবী এক ম্যাগাজিনের আলোকে)
আব্দুল্লাহ ফাহীম
১৫.১২.২০১৩