– শাইখুল হাদীস মাওলানা হাফিয মাহমূদ হোসাইন সাহেব (দা.বা.)
আমার পরম শ্রদ্ধেয়, প্রাণপ্রিয় উস্তাদ শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক আমাদের মাঝে আর নেই। বিগত ১০ রজব ১৪৩৬ হিজরী, মোতাবেক ২৮ শে এপ্রিল রোজ বুধবার রাত ১০ টা ১৫ মিনিটে আমাদের ছেড়ে তিনি স্বীয় মাওলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন। এর আগের দিন মঙ্গলবার স্নেহভাজন মাওলানা আব্দুল মুকীত জালালাবাদী (শিক্ষক, জামেয়া দারুল হুদা, দক্ষিণ সুরমা) মারফত সর্বপ্রথম তাঁর অসুস্থতার খবর জানতে পারি। তৎক্ষণাৎ বিস্তারিতভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থা জানার জন্যে তাঁর বড় জামাতা আমার দীর্ঘ দিনের সাথী এবং একনিষ্ট বন্ধু মাওলানা সাইফুল আলম (বর্তমান মুহাদ্দিস, জামেয়া মাহমূদিয়্যা, সুবহানীঘাট, সিলেট এবং ইমাম ও খতীব লামাপাড়া শিবগঞ্জ জামে মসজিদ) এর কাছে ফোন করি। তিনি জানালেন যে, হুযূরের বড় ধরনের হৃদরোগ হয়েছে। শুক্রবার তিনি তাঁকে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার তাকে বলেছেন যে, হুযূর বড় ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন, তাঁকে রক্ষা করা কঠিন হবে। অতপর হুযূরের ইচ্ছায় এবং ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথম দু’দিন অর্থাৎ শনি ও রবিবার তাঁর অবস্থার উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু সোমবার থেকে আর উন্নতি হচ্ছে না। যার মানে হলো তাঁর অবস্থার অবনতি হতে যাচ্ছে। ডাক্তারের নিকট থেকেও কোন আশার বাণী শুনতে পাচ্ছেন না। তখন তিনি হুযূরের জন্যে দোয়া করতে এবং অন্যদেরকে তাঁর অসুস্থতার খবর জানাতে বলেন। হুযূরকে আমার সালাম পৌঁছাতে বলি। এরপর থেকে হুযূরের কথা বার বার স্মরণ হচ্ছিল এবং তাঁর সুস্থতার জন্যে রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করতে থাকি।
পরদিন বুধবার দিবাগত রাত ১০ টার পর হুযূরের অবস্থা জানার জন্যে মাওলানা সাইফুল আলম সাহেবের কাছে ফোন করি। তিনি ফোন রিসিভ করেন, কিন্তু কথা বলেন নি। তাকে তখন ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ বলতে শুনি। অতপর তিনি ফোনের লাইন কেটে দিন। তখনই আমার মনে আসে যে হয়ত হুযুরের অন্তিম মুহুর্ত চলছে। অতপর আমি স্নেহভাজন মাও: আব্দুল মুকীতকে হুযূরের অবস্থা জানার জন্যে ফোন করি। তিনি বলেন যে, আমি আজ হুযূরকে দেখতে ইবনে সিনায় গিয়েছিলাম। সময় সময় তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তাঁর বর্তমান অবস্থা কী, আমি জেনে নিয়ে শীঘ্রই আপনাকে জানাচ্ছি। প্রায় আধা ঘন্টা পর তাকে আবার ফোন করি। তখন তিনি জানান যে প্রায় দশটা পনের মিনিটে হুযূর ইহজগৎ ত্যাগ করে মহান মাওলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন। এ শোকসংবাদ শুনামাত্র “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন” পড়ে হুযূরের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকি। এরপর কয়েকদিন এমন গেছে যে, হুযূরের কথা বার বার স্মরণ হচ্ছিল। স্মৃতিপটে তাঁর নানা স্মৃতি ভাস্বর হয়ে উঠছিল। তাঁকে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারছিলাম না।
কিছুদিন আগে তিনি জানান যে, তারা হুযূরের জীবনের উপর একটি স্মরণিকা বের করতে যাচ্ছেন। এতে তিনি আমাকে একটি লেখা দিতে বলেন। আমি সানন্দে তা গ্রহণ করি এবং এ কাজে অংশগ্রহণকে নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করি। এরই ফলশ্রুতিতে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
‘ঢাকার হুযূর’ থেকে ‘মুহাদ্দিস সাহেব হুযূর’
হুযূরের দারস কেমন ছিল – তা আলোচনা করতে যেয়ে আজ থেকে প্রায় তেতাল্লিশ বছর পূর্বে যেতে হয়। তখন ছিল ১৩৯৩ হিজরী মোতাবেক ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দ। সে সময় আমি সিলেট দরগাহ মাদ্রাসায় সাফেলা সুওম (বর্তমান মুতাওয়াসসিতাহ ৩য়) বর্ষে লেখাপড়া করতাম। হুযূর তখন দরগাহ মাদ্রসায় সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োজিত হন। এর আগে তিনি ঢাকা বড়কাটরা মাদ্রাসায় উস্তাদ ছিলেন। তাই আমরা তাঁকে ‘ঢাকার হুযূর’ নামে ডাকতাম। দরগাহ মাদ্রাসায় থাকাবস্থায় এই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। সে বছর দরগাহ মাদ্রাসায় প্রথম জালালাইন ও মিশকাত এ দু’ জামাত এক সাথে খোলা হয় এবং পরের বছর তথা শাওয়াল ১৩৯৪ হিজরী, মোতাবেক ১৯৭৪ সালে দাওরায়ে হাদীসের জামাত খোলা হয়। তখন থেকে হাদীস শাস্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কিতাব: তিরমিযী শরীফ ১ম খন্ড এবং মিশকাত শরীফ ১ম খন্ড পাঠদানের মহান দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়। এছাড়া অন্যান্য জামাতের নানা গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কিতাবাদি পাঠদানের দায়িত্বও তাঁর উপরে ছিল। হুযূর অত্যন্ত সুন্দর ও সফলভাবে এসব কিতাবাদি পাঠদান করতেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল খুবই অভিনব, মনোমুগ্ধকর ও সহজবোধ্য। সকল পর্যায়ের ছাত্রই তাঁর পাঠদানে উপকৃত হতে পারত এবং তাঁর নিকট পড়ার জন্য সবাই আগ্রহান্বিত থাকত। তাঁর নিকট পড়ার জন্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করত। আমরা যখন কাফিয়া জামাতে উঠি তখন আমরা তাঁর নিকট নাহ্ও শাস্ত্রের জটিলতম কিতাব ‘কাফিয়া’ পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বরাবর আকুল আবেদন করি। আমাদের আবেদন গৃহীত হয় এবং আমরা হুযূরের নিকট এ গুরুত্বপূর্ণ কিতাবটির পাঠগ্রহণ করে ধন্য হই। তাঁর নিকট ছাত্রদের পড়ার এ আগ্রহ দেখে দরগাহ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন মুহতামিম এবং দরগাহ মসজিদের দীর্ঘকালীন ইমাম আরিফ বিল্লাহ হযরত মাওলানা হাফিয আকবর আলী রাহ. রসিকতা করে বলতেন, “ঢাকার হালওয়া, খাউলা খাউলা”।
পাঁচ বছর পর শাওয়াল ১৩৯০ হিজরী, মোতাবেক ১৯৮০ সালে আমরা যখন দাওরায়ে হাদীসের জামাতে উঠি তখন সর্বপ্রথম বুখারী শরীফ ২য় খন্ড পাঠদানের দায়িত্ব হুযূরের উপর আসে। তিনি অত্যন্ত সফলতা ও আগ্রহের সাথে এ গুরু দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। আমরাও নব উদ্যমে ও প্রবল উৎসাহের সাথে তাঁর নিকট এ মহান কিতাব পড়তে থাকি। তখন দরগাহ মাদ্রাসার শাইখুল হাদীস ছিলেন হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল হান্নান দিনারপুরী রাহ.। তিনি এ বছর পবিত্র হজ্জ পালন করেন এবং হজ্জ সম্পন্ন করার পর পবিত্র মক্কা শরীফে ইন্তিকাল করেন এবং বিখ্যাত ‘জান্নাতুল মুআল্লা’য় সমাহিত হন। দরগাহ মাদরাসার মুহতামিম হযরত ‘ইমাম সাহেব হুযূর’ অন্যান্য বছরের ন্যায় সে বছরও হজ্জে গমন করেছিলেন। তিনি হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর দাওরায়ে হাদীস জামাতের কিতাবাদি পাঠদানের জন্য নতুন রুটিন করেন এবং বুখারী শরীফ ১ম খন্ড পাঠদানের দায়িত্ব আমাদের প্রিয় ‘ঢাকার হুযুরে’র উপর অর্পন করেন। তিনি এ মহান দায়িত্ব অত্যন্ত সুন্দর ও সফলভাবে সম্পন্ন করছিলেন এবং আমরাও নব উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে তাঁর নিকট এ কিতাবটি পড়ছিলাম। কিন্তু এক মাস না যেতেই ঘটে যায় বিপত্তি। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকর্তৃক একজন নতুন শাইখুল হাদীস নিয়োগ দেয়া হয় এবং বুখারী শরীফ ১ম খন্ড সরিয়ে বুখারী শরীফ ২য় খন্ড পাঠদানের দায়িত্ব হুযূরের উপর পুনরায় অর্পন করা হয়। অনুরূপ আরো কয়েকজন সিনিয়র মুহাদ্দিসকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের এহেন সিদ্ধান্তকে তাঁরা নিজেদের জন্য চরম অবমাননাকর বোধ করেন এবং খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত হন। ফলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ বিরোধ দিন দিন বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে দরগাহ মাদ্রাসার পবিত্র অঙ্গন তাঁদের প্রতিকুল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা দরগাহ মাদ্রাসা ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ১৪০১ হিজরী সনের জুমাদাল ঊলা মাসের মাঝামাঝি সময়ে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে নিজেদের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল দরগাহ মাদ্রাসা থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। অতপর কানাইঘাট থানাধীন রাজাগঞ্জ ইউনিয়নবাসীর আমন্ত্রণে রাজাগঞ্জ মাদ্রাসায় চলে যান। এবং এ মাদ্রাসাকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত উন্নীত করে সেখানে হাদীসের কিতাবাদি পাঠদান আরম্ভ করেন। আমরা ক’জন সাথীও তাঁদের সাথে রাজাগঞ্জ মাদ্রাসায় চলে যাই। হুযূর সেখানে শাইখুল হাদীস হিসেবে নিয়োজিত হন। আমরা হুযূরের নিকট এ মহান কিতাবের পাঠগ্রহণ করে তৃপ্ত ও ধন্য হতে থাকি। এরপর হুযূর জীবনের শেষ অবধি ‘শাইখুল হাদীস’ হিসেবেই বিভিন্ন মাদ্রাসায় হাদীস শিক্ষাদান করেছেন। এবং শ’ শ’ জ্ঞানপিপাসু তাঁর নিকট বুখারী শরীফ, তিরমিযী শরীফ ও মিশকাত- এ তিনটি কিতাব পড়ে নিজেদের জ্ঞানপিপাসা নিবারণ করে হাদীসের ইজাযত ও সনদ লাভে ধন্য হয়েছেন।
উপরের এ নাতিদীর্ঘ আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, দরগাহ মাদ্রাসায়ই হুযূর ‘শাইখুল হাদীসে’র পদ অলংকৃত করেছিলেন। যদিও এ তথ্যটি আজ অনেকেরেই অজানা।
হুযূরের দারসে হাদীসের বৈশিষ্ঠ্য
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, হুযূরের দারস তথা পাঠদান পদ্ধতি ছিল অনন্য। অত্যন্ত সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায়, খুবই আকর্ষনীয় ও মনমুগ্ধকর ভঙ্গিতে তিনি হাদীসের পাঠদান করতেন। পাঠদানকালে তার বক্তব্য হত নাতিদীর্ঘ এবং সাজানো-গোছানো। তাঁর দারসে হাদীসের কতিপয় বৈশিষ্ট নিম্নে উল্লেখ করছি:
১) হাদীসের কিতাবাদি পাঠদানকালে হাদীস সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তিনি প্রাণবন্ত ও মনযোগ আকর্ষনকারী আলোচনা করতেন যে ছাত্ররা সবাই তা খুবই মনযোগ সহকারে শুনত। কেউ অমনযোগী বা অন্যমনস্ক হতে পারত না।
২) পাঠদানকালে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সহজবোধ্য ও সাবলীল হত যে উপস্থাপিত বিষয়াবলী ছাত্ররা অতি সহজেই আয়ত্ব করতে পারত। অনেকেই তাঁর পূরো বক্তব্য লিপিবদ্ধ করত। মিশকাত শরীফ ১ম খন্ড হুযূর যে বক্তব্য দিতেন তা ‘দারসে মিশকাত’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। এত্থেকে তাঁর পাঠদান পদ্ধতির কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
৩) পরষ্পরবিরোধী হাদীসসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনে বিভিন্ন মনীষীর মতামত এমন সুন্দরভাবে পেশ করতেন যে সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয় দূর হয়ে যেত এবং কারো মনে কোন প্রকার প্রশ্ন থাকত না।
৪) কোন হাদীসের ব্যাখ্যায় নানামত থাকলে সেগুলো এমন প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করতেন যে সবার হৃদয়-মন আনন্দে ভরে যেত এবং সবাই তৃপ্তি অনুভব করত।
৫) বিরোধপূর্ণ মাসাইলে আইম্মায়ে কিরামের মাযহাবসমূহ ও তাঁদের প্রমাণাদি ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করতেন। অতপর হানাফী মাযহাবের বিপরীতে অন্যান্য মাযহাবের প্রমাণে পেশকৃত হাদীসসমূহের জবাবে হানাফী মতাবলম্বী মনীষীদের বক্তব্য এবং অন্যান্য মাযহাবের উপর হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্বের বিবিধ কারণ এমন মনমুগ্ধকর ভঙ্গিতে উপস্থাপন করতেন যে তা শ্রবণে ছাত্ররা সবাই বিমোহিত হয়ে যেত। অনাবিল আনন্দে সবার হৃদয়-মন ভরপুর হয়ে যেত এবং নিজ মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে কারো মনে কোন ধরনের সন্দেহ-সংশয় থাকত না।
৬) তিনি তাঁর দাদা-উস্তাদ বিশ্বসেরা মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ. এর নিতান্ত ভক্ত-অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর বিশাল ইলমের উপর ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। হাদীস পাঠদানকালে বার বার অতি শ্রদ্ধাভরে তাঁর নাম উচ্চারণ করতেন। তাঁর মতামতসমূহ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতেন। তার মতামতকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চূড়ান্ত মত বলেই গণ্য করতেন। তাঁর মতামত উল্লেখকালে অতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে বলতেন: حضرت شاہ صاحب فرماتے ہیں
৭) তিনি নিজ উস্তাদ বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা ইঊসুফ বান্নূরী রাহ. এর একান্ত ভক্ত অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর মতামতও দারসে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতেন। তাঁর মতামত উল্লেখকালে অতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও বিনয় সহকারে বলতেন: میرے شیخ حضرت بنوری علیہ الرحمہ فرماتے ہیں “আমার শায়খ হযরত বান্নূরী রাহ. বলেন”।
এভাবে হুযূরের দারসে পূর্বসূরী মনীষীদের বক্তব্যমালার অপূর্ব সমাহার ঘটত এবং তাঁদের মতামতের নির্যাস ও সারবত্ত¡া এসে যেত যা সচরাচর অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। এক সময় এমন ছিল যে, দারসে তিরমিযী, তানযীমুল আশতাত প্রভৃতি কিতাবাদি বিদ্যমান ছিল না। তখন হুযূরের দারসী তাকরীরই ছিল ছাত্রদের সহায়-সম্বল। মিশকাত শরীফ ১ম খন্ড ও তিরমিযী শরীফ ১ম খন্ড পাঠদানকালে তিনি যে বক্তব্য দিতেন তা ছাত্ররা নিয়মিত লিপিবদ্ধ করত বা অন্যের লিপিবদ্ধ কপি নকল করত। তা পড়েই ছাত্ররা পরীক্ষা দিত এবং ভাল ফলাফল করত।
বলতে দ্বিধা নেই যে, পঠন-পাঠন, বিশেষত হাদীস শাস্ত্রের কিতাবাদি অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাই ছিল হুযূরের একমাত্র পেশা ও নেশা। এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত ও সাধনা। এছাড়া অন্য কোন কিছুর প্রতি তাঁর ছিল না কোন মোহ বা আকর্ষন। হাদীস শিক্ষাদানের অঙ্গনে তিনি ছিলেন সেরা ও অনন্য। প্রায় অর্ধ শতাব্দী এ পবিত্র অঙ্গনে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বস্তুত এ ময়দানে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্ধী ও অতুলনীয়।
জীবন সায়াহ্নে এসে আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে গ্রন্থনা ও রচনার প্রতিও তিনি মনযোগী হন এবং দারসে মিশকাত ও দারসে বুখারী নামে দু’টি অতি মূল্যবান কিতাব রচনা করেন। এগুলো তাঁর অমর কীর্তি এবং হাদীস শাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের বিশালতার জলন্ত প্রমাণ। তাঁর ইন্তিকালে যদিও তাঁর ‘দারসী শাগরিদ’ সৃষ্টির ধারা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এ কিতাব দু’টি দ্বারা তাঁর অসংখ্য অগণিত ‘কিতাবী শাগরিদ’ সৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকবে। হাদীস শাস্ত্রের জ্ঞানপিপাসুরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ কিতাব দু’টি দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে। ইনশাআল্লাহ।
দোয়া করি যেন মহান আল্লাহ হুযূরের জীবনের যাবতীয় দারসী ও কিতাবী খেদমত এবং অন্যান্য নেক আমল কবুল করেন এবং জান্নাতে উচ্চতম মাকাম দান করেন। আমীন।