আল্লামা ইসহাক রহ. এর তাকওয়া ও খোদাভীতি

আল্লামা ইসহাক রহ. এর তাকওয়া ও খোদাভীতি

-মাওলানা আবদুল মুকীত জালালাবাদী (রাহ.)

 

২০০১ খ্রি. থেকে আমার কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে এবং ক্ষেত্রে যে সকল বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম এবং মুহাদ্দিসীনে এযামের সোহবত ও সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে- তন্মধ্যে শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস, পবিত্র বুখারী ও মিশকাত শরীফের কালজয়ী ব্যাখ্যাতা আল্লামা ইসহাক রহ.। আমি তাঁর সঙ্গে তিনটি সূত্রে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। যথা- ১. তাঁর প্রিয় শিষ্য এবং আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফিয মাহমূদ হোসাইন সাহেব, আমার খাস উস্তাদ ও তাঁর প্রধান জামাতা হযরত মাওলানা সাইফুল আলম সাহেব এবং দারসে মিশকাতের সংকলক শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফিয গৌছ উদ্দীন রহ. এর মাধ্যমে; ২. দারসে মিশকাত এবং দারসে বুখারী অধ্যয়নের মাধ্যমে; ৩. সিলেট জেলার অন্যতম দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাহমুদিয়া ইসলামিয়া সোবহানীঘাট মাদরাসায় একসঙ্গে শিক্ষকতা করার মাধ্যমে। সোবহানীঘাট মাদরাসায় তাঁর শুভাগমনের পেছনে আমারও ক্ষুদ্র ভূমিকা ছিল। ফলে কিছুদিন তাঁকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁর আমল-আখলাক ও ব্যক্তিত্ব কিছুটা উপলব্ধি করার সুযোগ হয়। আমরা তাঁকে স্পষ্টভাষী, নির্ভেজাল, নির্মোহ, সহজ-সরল, সাদা-সিধে জীবনযাপনের অধিকারী এবং তাক্বওয়া ও খোদাভীরু ব্যক্তি হিসাবে দেখতে পেয়েছি।

বায়আত ও ইজাযত লাভ:

আইম্মায়ে হাদীস এবং মুহাদ্দিসীনে কেরামের সীরাত-সুরত, তাক্বওয়া ও পরহেযগারীর বাস্তব নমুনা এবং তাঁদের চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। মুহাদ্দিসীনে কেরাম যেভাবে ইলমে যাহিরী এবং ইলমে বাতিনীর অধিকারী ছিলেন, সেভাবে তিনিও উভয় ইলমের ধারক ও বাহক ছিলেন। যেহেতু তাক্বওয়া-পরহেযগারী, খোদাভীতি এবং মা’রিফাতে এলাহী হাসিল করার জন্য ইলমে বাতিনী তথা তাসাউফ ও আধ্যাত্মিক সাধনার বিকল্প নেই। তাই আল্লামা ইসহাক রহ. তাঁর প্রিয় উস্তাদ আল্লামা সৈয়দ ইউসুফ বান্নুরী রহ. এর কাছে হাদীসের উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করার পর ইলমে বাতিনী হাসিল করার জন্য তাঁর হাতেই বায়আত গ্রহণ করেন।

বাল্যকাল থেকেই আল্লামা ইসহাক রহ. নামায-রোযা, ফরয-ওয়াজিব এবং সুন্নাত ও মুস্তাহাবের পাবন্দ ছিলেন। আর মানসিকভাবে ছিলেন সহজ-সরল ও হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা এবং অন্যান্য বাতিনী রোগ থেকে মুক্ত। তাই রুহানী জগৎ অতিক্রম করতে তাঁর বেশ সময় লাগে নি। ফলে শায়খের সোহবতে কিছুদিন রিয়াযত এবং মুজাহাদা করার পর খেলাফত ও ইজাযত লাভে ধন্য হন।

প্রচারবিমুখতা:

তিনি যে আল্লামা বান্নুরী রহ. এর খলীফা ছিলেন; একথাটি তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠজনের জানা আছে কি না! আমার সন্দেহ। আর তাঁর নিজের কোন খলীফা আছেন কি না? তাও কারো জানা আছে কি না? সন্দেহ। বাকি রইল মুরীদের ব্যাপার, থাকলে কয়জন? নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর পীর-মুরিদীর উদ্দেশ্য ছিল নিজের আমল-আখলাকের ইসলাহ, কাউকে মুরীদ করা এবং খেলাফত দান করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। ফলে তিনি সহজে কাউকে মুরীদ করতেন না। অথচ তাঁর মত প্রাজ্ঞ আলিম, জামাল-কামালের অধিকারী এবং আদর্শ ও অনুসরণীয় চরিত্রের হাজার হাজার মুরীদ এবং শতাধিক খলীফা থাকার কথা। আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে এই প্রচারবিমুখতাই তাঁর তাক্বওয়া ও পরহেযগারির শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা সৈয়দ ইউসুফ বান্নুরী রহ. হাদীসের সনদ ও ইজাযত প্রদান কালে আল্লামা ইসহাক রহ. কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘ইসহাক! তুমি দেশে গিয়ে নিরলসভাবে ইলমে হাদীসের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের খেদমতে নিয়োজিত থাকবে’। উস্তাদের এই বিশেষ নসীহত এবং নির্দেশই হয়তো তাঁকে নিয়মতান্ত্রিক ওয়াজ-নসীহত ও তাসাউফের খেদমত থেকে বিরত রেখেছে।

মুরীদ হওয়ার শর্ত:

আল্লামা ইসহাক রহ. আদৌ কোনো বুযুর্গের খলীফা কি না? থাকলে কার খলীফা? একথা তিনি সোবহানীঘাট মাদরাসায় আসার পূর্বে আমাদের জানা ছিল না। একদিন আমাদের চা-চক্রের বৈঠকে বায়আত ও মুরীদ হওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে। তখন মাদরাসার দীর্ঘদিনের উস্তাদ এবং মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল মুছাব্বির জামডরী সাহেব কার কাছে বায়আত হবেন? তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুক্ষণ আলোচনার পর তিনি এবং আমি বললাম, যদি আল্লামা ইসহাক রহ. কারো খলীফা হন, তাহলে তাঁর কাছে বায়আত হওয়া বেশ উপকারী হবে। এরপর আমরা তাঁর খেদমতে এসে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, হুজুর! আপনি কার কাছে বায়আত এবং কার খলীফা? কিছু পীড়াপীড়ি করার পর বললেন, আমার শায়খ আল্লমা ইউসুফ বান্নুরী রহ. তিনি আমার হাদীসেরও শায়খ এবং তাসাউফেরও শায়খ। দেশে আসার সময় তিনি আমাকে হাদীসেরও ইজাযত দিয়েছেন এবং তাসাউফেরও ইজাযত দিয়েছেন। তখন আমরা জানতে পরলাম তিনি আল্লামা বান্নুরী রহ. এর খলীফা। কিন্তু তাঁর পক্ষ থেকে এর কোনো প্রচার-প্রসার নেই। সোবহানাল্লাহ! কতটুকু সংযত মুত্তাক্বী ও পরহেযগার হলে এমন প্রচারবিমুখ চরিত্র হওয়া যায়।

অথচ আমাদের বর্তমান অবস্থা হচ্ছে- খিলাফত লাভের পূর্বেই ভক্তদের পক্ষ থেকে প্রচার শুরু হয়ে যায়, তিনি তো খেলাফতী পেয়ে যাবেন……। ভাগ্যক্রমে খেলাফতী পাওয়ার পরে তো আর উপায় নেই। প্রচার-প্রচারণার গতি শতগুন বেড়ে যায়! আর না পেলে সূক্ষ্ম লবিং শুরু হয়। অতঃপর মাওলানা আব্দুল মুছাব্বির সাহেবকে বললেন, ঠিক আছে মুরীদ হওয়া বড় কথা নয়, বরং ইসলাহ ও সংশোধন হওয়াই মুখ্য বিষয়। তাই তুমি ইস্তেখারা কর।

এশকে রাসূল:

আল্লামা ইসহাক রহ. তাঁর শায়খের কাছ থেকে একই সঙ্গে যাহিরী ও বাতিনী ইলমের ইজাযত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং ফারিগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলমে হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত হয়ে যান। ফলে রাসূল সা. এর সঙ্গে তাঁর রূহানী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার দরুণ প্রায় সময় তিনি রাসূলপ্রেমে বিভোর থাকতেন। সময়-সুযোগ হলেই মুরাকাবা এবং মুশাহাদায় মগ্ন থাকতেন। যানবাহনের দু’আড়াই ঘন্টার সফর অবস্থায় মুরাকাবা করতেন। বাসগৃহে একা হলেই তিনি চোখবুজে বসে অথবা শুয়ে মুরাকাবায় মগ্ন হয়ে যেতেন। অনেক আগন্তুক বা খাদিম-খুদ্দামরা তাঁর ধ্যানরত থাকার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারতো না। তাই তারা ঘুমন্ত মনে করে ডাক দিয়ে ধ্যানমগ্নতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করত। যার দরুণ তিনি কোনো সময় ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। কিন্তু বাস্তবতা খুলে বলতেন না। পীড়াপীড়ি করলে শর্তসাপেক্ষে বলতেন। কর্মস্থল বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনকালে ইস্তিখারা করতেন, রাসূলের ইশারা গ্রহণ করতেন। সোবহানীঘাট মাদরাসায় আসার কাহিনী এবং ইস্তিখারার ঘটনা তিনি নিজেই দরসে বুখারীর মাহফিলে বর্ণনা করেছেন।

দৈনন্দিন আমল:

আল্লামা ইসহাক রহ. এর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত নির্মল, পরিপাটি ও রুটিনবদ্ধ। তাঁর প্রতিটি কাজের সময় নির্ধারিত থাকতো। নিম্নে তাঁর প্রতিটি দৈনন্দিন আমল ও চাল-চলনের একটি খসড়া রুটিন তুলে ধরা হলো-

১. মেঘ-বৃষ্টি ও ঝড়-তুফান হলেও জামাআতসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ২. বাদ ফজর কুরআন তিলাওয়াত করা ৩. দুপুর ১২টা পর্যন্ত দরসে বুখারী ও তা’লীম-তাআল্লুম ৪. ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কায়লুলা ৫. বাদ যোহর থেকে মুতালাআ এবং মেহমানদের সাক্ষাৎ প্রদান ৬. বাদ আসর তাফরীহ ও পায়চারি ৭. বাদ মাগরিব দরসে বুখারী ৮. বাদ এশা আহার অতঃপর নিদ্রা যাওয়া ৯. শেষরাত্রে তাহাজ্জুদের নামায ও রোনাজারি।

তাছাড়া ১. তাঁর লেনদেন থাকতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ২. কথা-বার্তা স্পষ্ট ও বিভ্রাটমুক্ত ৩. অহেতুক খেদমত বর্জন ৪. সন্দেহযুক্ত বস্তু ও বিষয় এড়িয়ে চলা তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উপরোক্ত বিষয়গুলি তাক্বওয়াভিত্তিক জীবনযাপনের নিদর্শন।

মোটকথা, তিনি সর্বদা তাক্বওয়া-খোদাভীতি ও তাসাউফের সুউচ্চ মাকামে অবস্থান করতেন এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতেন।

Scroll to Top